Ads

ইসলামী ব্যাংকিং পেশায় তিন যুগ (১৯৮৪-২০১৯)।। দ্বিতীয় পর্ব

।। মু. শামসুজ্জামান ।।

ব্যবসা হিসাবে ব্যাংকিং উত্তম বিবেচিত হলেও ইসলামী ব্যাংকিং ছিলো নবীন,অভিজ্ঞতাহীন এবং বলা চলে অনিশ্চিত গন্তব্যের মতো। ফলে পুঁজির যোগানদার স্পনসর খুঁজে পাওয়া ছিলো কষ্টকর। ধনীরা মোটেও এগিয়ে আসেন নি। যারা তখন এগিয়ে এসেছিলেন তারা ইসলামী ধ্যান ধারনার উজ্জিবীত হয়ে প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক সরকার ও ব্যাংকসহ কিছু প্রতিষ্ঠানকে রাজী করিয়ে পুঁজি সংগ্রহ করা হয়। আই ডি বিও ভূমিকা রাখে। তখনকার সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সহযোগীতা দেয়। ফলে ইসলামী ব্যাংক আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হয়।

এমন আশংকা পেশা হিসাবে ইসলামী ব্যাংকিং বেছে নেয়ার ক্ষেত্রেও কমবেশী ছিলো। যারা প্রবীন ও সিনিয়র হিসাবে অন্য ব্যাংকের সুবিধাময় সুন্দর জীবন ছেড়ে এখানে এসেছিলেন তাদের সামনে কেবল আল্লাহর সন্তষ্টি ব্যতীত আর কিছু ছিলো না। অনেকে গাড়ী বাড়ী রেখে এসেছেন, কয়েকজন তো উচ্চপদস্থ বিসর্জন দিয়েছেন। শুনেছি কয়েকজনকে তাদের পূর্বের কর্মস্থলের পাওনাও দেয়নি। অনেকে পেশাগত হেনস্তার শিকারও হোন। এরকম একটা অনিশ্চিত অবস্থায় যে সকল প্রবেশানার প্রথম ব্যাচে যোগ দেন তারা, বলা চলে,সবাই এটা মাথায় রেখেই যোগ দিয়েছেন।

যোগদানের পর লোকাল অফিসে আমাদের প্রাথমিক পোস্টিং হয়। মতিন উদ্দিন ভুইয়া স্যার লোকাল অফিসের চার্জে তখন। অত্যন্ত অমায়িক,স্বল্পভাষী ও সজ্জন ব্যক্তি। লিখার সময় তিনি তিনটি কলম ব্যবহার করতেন- লাল,কালো ও সবুজ। অতি প্রয়োজনীয় ও সতর্কতামূলক চিঠিতে লাল, দাপ্তরিক নির্দেশে সবুজ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কালো কালির ব্যবহার । আর কোন সিনিয়রের কলমে দেখিনি। উনার সবুজ কালিতে স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে ৩০ মার্চ ১৯৮৪ আমি ও বন্ধু জালাল আকবর আগ্রাবাদ শাখা, চট্টগ্রামে বদলি হই।

ইতোমধ্যে ঢাকার চকবাজার শাখা (বর্তমানে চক মোগলটুলি শাখা) ও চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শাখা ওপেন হয়ে যায়। হেড অফিস ও লোকাল অফিসে অবস্থানকালে আমাদের কয়েকটি কাজ মূখ্য ছিলো। চিঠিপত্র ডিসপাস, লেজার পোস্টিং,ডে বুক লিখন। কাজগুলো বেশ উপভোগ্য হলেও দিনশেষে ক্লীন ক্যাশ বই না মিললে শুরু হতো যন্ত্রনাদায়ক খোঁজাখুঁজি। এর বাইরে সপ্তাহান্তে বড় আজাব চাপতো লেজার ব্যালান্চিং এ। দুনিয়ার তাবৎ ভয় ও আতংক ঐ একদিন পেয়ে বসতো। একক ঘরের যোগ নামতায় দেরী হতো বলে একক দশক দুই ঘর একত্রে যোগ নামতা শিখেছিলাম।

একদিন বিকেলের কথা। পোস্টিং শেষ,ডে বুক লিখার পালা। খবর এলো কোন এক লেজারের ভাউচার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তলব শুরু হলো। কে সেই লেজারে পোস্টিং দিয়েছে। আমার নাম বলা হলো। আমাকে ডাকা হলো এবং যার পর নাই বকা দেয়া হলো। জীবনে বাবা বা শিক্ষকদেরও এতো বকা খাইনি। সহ্য করতে না পেরে কেঁদে দিয়েছিলাম। ঘটনা শুনে এইচ আর হেড তাজুল ইসলাম স্যার চলে এলেন শান্তনা দিতে। পরে সেই ভাউচারটি টেবিলের এক কোণে পাওয়া যায়।

ম্যানুয়েলী যারা কাজ করেছেন,সত্যিকার ব্যাংকিং এর পোড়া কস্ট তারা কিছুটা উপলব্দ্ধি করবেন । কিন্ত আজকের সিবিএস এর জমানায় এর উত্তাপ ব্যাংকাররা আঁচই করতে পারেন না। দু’দিন আগে এনুয়েল ক্লোজিং হয়েছে অথচ সেই সময়ে ক্লোজিং এর কথা শুনে রীতিমতো গায়ে জ্বর এসে যেতো। জীবনের প্রথম ক্লোজিং এর সময়ে হোটেলে রমজানের সেহরী খেয়ে আবার কাজ শুরুর কথা পরে বলবো,এখন নয়।

মনে পড়ে, ইসলামী ব্যাংক হয়েছে একথা শুনে কতো দূর দূরান্ত থেকে লোকেরা হিসাব খোলার জন্য জমানো টাকা নিয়ে ঢাকা চলে আসতো। সে কী আগ্রহ,আকুলতা! অনেককেই দেখেছি অনেক সন্মানের সাথে বাইরে জুতা খুলে ব্যাংকে ঢুকতেন। কেউ ঢুকে জমিনের জায়নামাজে সিজদা দিতেন,কেউ খিলানে হাত লাগিয়ে চুমো খেতেন। এক বৃদ্ধের কথা জীবনেও ভুলবো না । যিনি হাঁটতেন কস্ট করে লাঠিতে ভর দিয়ে, বুকার আস্তিনে করে জমানো কিছু কয়েন নিয়ে এসে কাউন্টারে দাঁডিয়ে আছেন এই অপেক্ষায় যে তার কয়েনগুলো জমা নেয়া হবে। জিজ্ঞাসা করে জানা গেলো সুদূর মানিকগন্জ থেকে তিনি এসেছেন। তার ধারনা, ব্যাংকে এই কয়েনগুলো জমা হলে তিনি এই সাহায্যর অসিলায় জান্নাতে যাবেন।

এগুলো এই প্রজন্মের কাছে কাহিনী মনে হতে পারে, কিন্ত মিথ্যা নয় । এমন অসংখ্য নাম না জানা আল্লাহর বান্দার দোয়া, চোখের পানি আর তাহাজ্জুতের ফসল এই ব্যাংক। সেমিনার সিম্পোজিয়ামে কোনদিন হয়তো তাদের নাম উচ্চারিত হবে না, কোন গ্রন্থে তারা ইতিহাস হয়ে জায়গা পাবেন না । কিন্ত এই প্রতিষ্ঠানের দেয়ালের প্রতিটি বালিবিন্দুতে অলক্ষ্যে তাদের ক্রন্দন আহাজারি শোনা যাবে।

চলবে-

আগের পর্ব-ইসলামী ব্যাংকিং পেশায় তিন যুগ (১৯৮৪-২০১৯)-প্রথম পর্ব

লেখকঃ  মু. শামসুজ্জামান, সাবেক এডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি

 

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ,পরিবার ও আত্মউন্নয়ন মূলক অসাধারণ লেখা ও আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi এ লাইক দিয়ে ফেসবুকে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন।প্রিয় লেখক! আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; প্রিয় লেখক ও পাঠক আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন ।

আরও পড়ুন