Ads

পিতার আত্মহত্যা

হারুন হাফিজ

স্ত্রী ও তিনখান ছেলে মেয়েকে সাথে নিয়ে সোলাইমান নিকটস্থ মোহাম্মাদপুর থানায় গেলেন। এ সময় থানা চত্বরে পাঁচখান পুলিশ টহলরত ছিলেন। সোলাইমানদের আসতে দেখে কনস্টবল জাকারিয়া এগিয়ে এসে বলল, “এখানে কি, কাকে চাও”। জড়সড় হয়ে দুইখান হাত মাফ চাওয়ার মতো করে আকুতি ভরে সোলাইমান বলল, “সার একটু দয়া করেন, ঘরে খাওআ দাওআর মতো কিছু নেই, দয়া করে একটু সাহায্য করেন সার। বৌ পোলাপান নিয়ে মুসিবতে আছি। কাল রাতে কোনোমতে খাইছি। আজ সকালে এখানো কিছু খাইনি, একটু দয়া করেন সার।”

কনস্টবল জাকারিয়া সোলাইমানকে বলল, “তুমি কি করো, তোমাদের এলাকায় কেউ খাবার টাবার দিচ্ছে না? সোলাইমান বলল, দেচ্ছে সার। সবাইরে না, কিছু কিছু লোকজনরে দেচ্ছে। আমি আগে মাটি কাটতাম, এখন শরীল তেমন ভাল না তাই মাটি কাটি না সার। মাটি কাটা বাদে সব কাজকামই করি সার। মাঝেমাঝে শহরে যেয়ে রিক্সাও চালাই সার।”

সোলাইমানদের কথার ফাঁকে আরো দুইখান পুলিশ কাছে এসে দাঁড়ালো। সোলাইমান ও তার স্ত্রী ছেলে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে জাকারিয়া বুঝতে পারলো আসলেই তারা নিরুপায় হয়েই এখানে এসেছে। সোলাইমানদের একটু অপেক্ষা করতে বলে জাকারিয়া ভিতরে গেলেন।সোলাইমানের বয়স আনুমানিক ৫৫ বছর। স্ত্রীর কমবেশি ৫০ হবে। সোলাইমানের দুইখান মেয়ে একখান ছেলে। বড় দুই মেয়ের বয়স যথাক্রমে ১২ ও ৯ বছর আর ছোট ছেলেটির ৭ বছর।

কিছুক্ষণ পর জাকারিয়া দূর থেকে হাত নেড়ে আরেকটু অপেক্ষা করতে বলল সোলাইমানদের। এতে মনের অজান্তে কিছুটা আশান্বিত হলো সোলাইমান। এর কিছুক্ষণ পর সামনে টহলরত আরেকখান পুলিশ ভিতরে গেলো। সম্ভবত জাকারিয়াই ডেকে পাঠিয়েছে ভিতরে।

এরপর মিনিট দশেক পরে কনস্টবল জাকারিয়াসহ অপর এক পুলিশ সদস্য সোলাইমানদের দিকে আসতে লাগলো। তাদের দুজনের হাতে দুটি থলে। কাছে এসে সোলাইমানের হাতে থলে দুটি ধরিয়ে দিয়ে কনস্টবল জাকারিয়া বলল, “এখানে ৫কেজি চাল, কেজিখানিক তেল আর কিছু আলু আছে। আমাদের কিচ্ছু করার নাই ভাই, তোমার অনাহারী অবুঝ ছেলে মেয়ের কথা চিন্তা করে আমাদের স্যার এই সামান্য কিছু চাল ডালের ব্যবস্থা করেছেন। এগুলো নিয়ে আপাতত ঘরে ফিরে যাও। বড় কোনো বিপদ না হলে ঘর থেক বাইরে বের হওয়ার দরকার নাই, ঠিক আছে?” কথা গুলো দরদমাখা কন্ঠেই বলছিলেন জাকারিয়া।

কিছু খাবারের ব্যবস্থা হয়েছে দেখে সোলাইমান ও তার স্ত্রীর চোখে পানি এসে গেলো। তারা বাকরুদ্ধ হলো। বড় মেয়েটির মুখেও ফুটে উঠলো আনন্দের ছাপ। ছোট ছেলেটি থলে ধরে নড়াচড়া করছে আর বিড় বিড় করে কি যেন বলছে তার বড় বোনকে। এসব দেখে কনস্টবল জাকারিয়াও কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে উঠলেন। এই অবস্থায় সেখানে কিছুক্ষণের জন্য বসলো সুখ দুঃখের ছোট্ট পসরা।

পুলিশদের প্রতি বিশেষ করে কনস্টবল জাকারিয়ার প্রতি শ্রদ্ধামূলক শুকরিয়া জানিয়ে ঘরে ফিরতে চাইলেন সোলাইমানরা। কয়েক কদম যেতেই পেছন থেকে ডাক দিলেন জাকারিয়া। কাছে এসে মানিব্যাগ থেকে দুইখান ৫০ টাকার নোট ধরিয়ে দিলেন সোলাইমানকে। বললেন এই টাকা দিয়ে নুন হলুদ কিনে নিয়েন। এবার যান।

সোলাইমানরা তাদের খুপরিতে ফিরে গেলেন।পুলিশদের এই সহানুভূতির কথা এক খুপরি থেকে আরেক খুপরিতে পৌছে গেলো। খুপরির লোকজন বলাবলি করতে লাগলো নেতাদের আশায় বসে না থেকে সোলাইমানের মতো তারাও থানায় গিয়ে চাল ডালের ব্যবস্থা করবে। এরই মধ্য খুপরির একজন অভাবী লোক তার স্ত্রীকে সাথে করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে থানায় গেলেন। যেয়ে দেখলেন তিনখান পুলিশ থানা চত্বরে একত্রে দাঁড়িয়ে গল্প গুজব করছে। সেখানে গিয়ে লোকটি তার দুঃখ দুর্দশার কথা জানালেন। বললেন, তিনি কিছু সাহয্য পাওয়ার আশায় এসেছেন। তিন জনের মধ্যে একখান পুলিশ বলল, “স্যার তো নাই, তিন চার দিন পরে আসেন।” লোকটির মন ভেঙে গেলো এবং সেটি চোখে মুখেও ফুটে উঠেছে। লোকটি আবারো বলল, “সার কিছু করা যায় না? কদিন ধরে কোনোমতে খায়েপরে আছি, আজ এখনো কিছু খায়নি সার।”

পুলিশটি আবারো বলল, “বললাম তো স্যার নাই, তিন চারদিন পরে আসেন। তখন আসলে স্যারকে পাবেন। আর স্যার আসলে আপনার কথা বলবো, ঠিক আছে? এখন যান চাচা।”ভাঙা মন নিয়ে খুপরিতে ফিরে গেলো লোকটি। এই কথা সোলাইমানের কানে পৌছালো। সোলাইমান এখন ভীতসন্ত্রস্ত। সে যে সাহায্য পেয়েছিলো তা আর অবশিষ্ট নাই। এর ঠিক ছয়দিন পর খবর বেরোল, “সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে না পারাই পিতার আত্মহত্যা ”

লেখকঃ মালয়েশিয়া প্রবাসী কবি ও সাহিত্যিক

পিতার আত্মহত্যা গল্পের লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল 

পিতার আত্মহত্যা গল্পের সাথে আরও পড়ুন-

ফেসবুকীয় ভালোবাসা

 

আরও পড়ুন