Ads

প্রেরণার আরেক নাম ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ

ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ

ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, একটি নাম একটি ইতিহাস। তিনি শুধুমাত্র একজন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিই ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন প্রাচ্যের চলন্ত বিশ্বকোষ। তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল বিশাল সমুদ্রের মতো, তিনি ছিলেন বহুভাষাবিদ। তাঁর ইতিহাস আমাদের আলোর পথে হাঁটতে শেখায়। নিজেকে ভাবতে শেখায় গর্বিত মানুষের উত্তরসূরী হিসেবে।

পেয়ারা গ্রাম। পেয়ারা ফলের মতোই সবুজ এবং মজাদার। পুষ্টিগুণেও কম ছিলনা। তাই ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতো মহামণিষী তৈরি হয়েছিলেন এখান থেকেই। তাঁর জন্ম হয়েছিলো ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই। বর্তমান পশ্চিমবাংলার চব্বিশ পরগনার বসিরহাটের পেয়ারা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম মফিজ উদ্দীন এবং মাতার নাম হুরুন্নেছা খাতুন।

ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার প্রতি খুব ঝোঁক ছিল মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর। ছোটবেলার ঘরোয়া পরিবেশেই তিনি উর্দু, ফারসি ও আরবি ভাষা শেখেন। সংস্কৃত ভাষা শেখেন স্কুলে। শিক্ষা জীবনের তিনি কলকাতা সিটি কলেজ থেকে ১৯১০ সালে সংস্কৃতে বি.এ অর্নাস এবং ১৯১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে এম. এ পাশ করেন। অতঃপর ১৯১৪ সালে বি.এল ডিগ্রিও অর্জন করেন তিনি।

ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর কর্মময় জীবনের প্রায় সবটাই শ্ক্ষিকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠিান তাঁর স্মৃতিতে ধন্য হয়েছে। শ্ক্ষিকতার পাশাপাশি তিনি লিখেছেন অজস্র লেখা। ইংরেজি ও বাংলায় নানা নামে লিখা প্রবন্ধ সব পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। তাঁর প্রথম প্রবন্ধের বই ভাষা ও সাহিত্য প্রকাশিত হয় ১৯৩১ সালে। আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, বাংলাসাহিত্যের কথা, বাংলাভাষার ইতিবৃত্ত প্রভৃতি গবেষণামূলক বই আজো তাঁর কীর্তি বহন করছে। তিনি ১৯২০ সাল থেকে (বাংলা ১৩২৭ এর বৈশাখ মাসের প্রথম সপ্তাহে) ছোটদের জন্য আঙ্গুর নামে একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন। টসটসে রসালো লেখায় ভরপুর থাকতো আঙ্গুরের প্রত্যেকটি পাতা।

বহু-ভাষাবিদ হিসেবে পাকভারত উপমহাদেশে ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর স্থান অদ্বিতীয়। মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও তিনি উর্দু, আরবি, ফারসি, সংস্কৃত, হিন্দি, মৈথিলা, আসামি, পালি, পাকূত, প্রাচীন ফারসি, তিব্বতি, আবেস্তান, হিব্রূ, ইংরেজি, ফরাসি, জার্মানসহ প্রায় আঠারটিরও অধিক ভাষার সাথে বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। এই ভাষাগুলোর মধ্যে সংস্কৃত, আরবি, উর্দু, পালি, ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় তাঁর পা-িত্য ছিল মাতৃভাষা বাংলার মতো। পাকভারত উপমহাদেশের মূল ভাষাগুলির উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে এজন্যই তাঁর সিদ্ধান্ত সন্দেহাতীতভাবে গ্রহণযোগ্য। কেননা তা বিজ্ঞান, তথ্য ও যুক্তি প্রামাণভিত্তিক। বাংলা ভাষার ইতিহাস ও বিকাশধারা রচনায় তিনি শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞজন। বস্তুত ভাষাবিদ হবার স্বার্থকতাই তাঁর সম্মুখে অপর সকল সাফল্যের দ্বার উন্মুক্ত করেছে। আমাদের সাহিত্যে বহুভাষাবিদ হিসেবেই তিনি সফলভাবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন ।

অধ্যয়নের মাধ্যমেই বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণে তাঁর অসাধারণ ব্যুৎপওি জন্মে। ব্যাকরণ সম্পর্কে তাঁর পরিবেশিত তথ্য অত্যন্ত নির্ভুল ও পরিচ্ছন্ন। তাঁর প্রকাশিত প্রবন্ধ ও গ্রন্থসমুহ এবং দেশে বিদেশে বিভিন্ন কনফারেন্সে অংশগ্রহণের তাৎপর্য ভাষাবিদ ও বৈয়াকরণ হিসেবে তাঁর স্থান যে অনেক সুউচ্চে তা নিঃসন্দেহে অনন্যসাধারণভাবে প্রমাণিত। বলা বাহুল্য, তাঁর জীবনের এই সার্থকতার মূলে মূলে রয়েছে তাঁর বহুভাষায় জ্ঞানের গভীরতা, বেশি বেশি পাঠাভ্যাস। তিনি সব সময় পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। লাইব্রেরিতে গিয়ে তিনি ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটিয়ে দিতেন; মাঝেমধ্যে এমনও হতো যে, কখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেছে তিনি টেরই পেতেন না। কখনো কখনো লাইব্রেরির লোকজন তাঁকে ভিতরে রেখে দরোজা জানালা বন্ধ করে চলে যেতেন। তাঁকে এক সময় জিজ্ঞাসা করা হলো, আপনি জীবনে কত বই পড়েছেন ? তিনি বলেছেন, ‘আমি কতো বই পড়েছি জানি না, তবে রাস্তায় একটা ছেঁড়া কাগজ পেলেও আমি তা কুড়িয়ে নিয়ে পড়েছি।’ জ্ঞান নামক রতনের খোঁজে তিনি সত্যিই সফল হয়েছিলেন।

ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর জীবনযাপন ছিলো খুব সহজ সরল। তিনি অহেতুক ব্যয় করা পছন্দ করতেন না। তিনি ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ। ওয়াজ মাহফিলের কোন দাওয়াত পেলেও সেখানে বক্তৃতা করতেন। তিনি ১৯৫৫ সালে হজ্জ পালন করেন। অবশেষে এই মহান পুরুষ ১৯৬৯ সালের ১৩ই জুলাই ৮২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। আষাঢ়ের ভরা বর্ষায় এসে আবার আষাঢ়েই চলে গেলেন সবার বুকে জ্ঞানের স্রোত বইয়ে দিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল চত্বরে তিনি চির নিদ্রায় শায়িত আছেন। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই। আছে তাঁর সাহিত্য ও কর্মময় দিনগুলোর পাণ্ডিত্যপূর্ণ ইতিহাস।

লেখকঃ সাহিত্যিক, কলামিস্ট, গবেষক এবং অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

আরও পড়ুন