Ads

ফুলবানুর শুভবিবাহ

হুমাইরা বিনতে হোসাইন

চলছে অগ্রাহায়ণ।সামনের পোষ মাসের প্রথম শুক্রবার আমাদের ফুল বানুর শুভবিবাহ। আমার ছোট্ট বাইশ বছর বয়সী জীবনের প্রথম ঘটকালী সফল হওয়ায় নিজের মধ্যে বেশ গর্বিত একটা ভাব চলে এসেছে।একাধারে ঘটক এবং পাত্র পাত্রী দু পক্ষের অভিভাবক হিসেবেও ইতিমধ্যে একটা পাকা অবস্থান তৈরী করে ফেলেছি।দু পক্ষই আমার মতামতের প্রাধান্য দিচ্ছে দেখে নিজের বয়সটা অল্প কদিনে বেশ কয়েক বছর বেড়ে গেছে বলেই মনে হচ্ছে।

ভাবছি অনার্স ফাইনালটা দিয়েই পুরোদমে ঘটকালি ব্যবসা শুরু করে দিব।তবে আমার ঘটকালীর চিন্তাটা একটু অন্যরকম। যেমন এখানে কোন এরেঞ্জ ম্যারেজ চলবে না।জগতের সব প্রেমিক প্রেমিকার গন্তব্যস্থল হবে।ঘটক টিয়া আপা।রীতিমতো পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে দিব।

এই যে আপা ভাই, জ্বী আপনাকেই বলছি,আপনি কি মনের মানুষকে বিয়ে করার চিন্তায় অস্থির?।আব্বা আম্মার সামনে মুখ ফুটে বলতে পারছেন না।চিন্তার কোন কারণ নেই।আজই যোগাযোগ করুন।ঘটক ময়না আপার সাথে।
ধুর এই ঘটকালি পেশার জন্য আমার নামটাও একটু চেঞ্জ করতে হবে।ঘটকের সাথে আমার চৈতী নামটা ঠিক যায় না।তাই নাম পাল্টে ঘটক ময়না টিয়া আপা, কিছু একটা রাখতে হবে।
আচ্ছা থাক বিজ্ঞাপন নিয়ে পরে ভাবা যাবে।
এবার ফুলির কথা বলি।

ফুলি সেদিন আমতা আমতা করে যখন বলল,
-আফা আপনারে একখান কতা কইবার চাই। শরম করতাছে যদিও। কিন্তু না কইলে দম আটকাইয়া মইরা যামু।
ফুলি সারাদিন পক পক করা মেয়ে,কি এমন কথা আমাকে বলতে চায়,তাও আবার লাজুক লতার মত নেতিয়ে আছে।
-কি ফুলি বলে ফেল ঝটপট।
-ইয়া মানে আপা আমার মন্টু ভাইয়ের সাথে ভাব ভালেবাসা চলতে আছে।একদম লাইলি মজনু মার্কা প্রেম।মন্টু ভাই কইছে আমারে বিয়া করব।

-কিন্তু শরমে কাউরে কইতে পারে না।
-হ্যা তো আমারে পলাইয়া যাওয়ার বুদ্ধি ও দিছে।
-ফুলি এখন সিরিয়াস মুডে চলে গেছে।ব্য ব্যাডার কথা হুইনা আমার তো গায়ের পশম খাড়া হইয়া গেছে আফা।
-বাহ্ মন্টু মিঞা দেখি বেশ সাহসী।তোমায় নিয়ে দেশান্তরী হতে চায়।
-ধুর আফা।পাগলের কথা কইয়েন না তো।
-হে নাকি আমারে না পাইলে পাগল হইয়া যাইব।
-এই দেহেন কেমন বিয়া করার জন্য পিছে পিছে ঘুরতেছে।
-তারে কইছি, শোন মন্টু মিঞা আমার জান থাকতে এই ক্যালেঙ্কারী করতে পারুম না।তাছাড়া বাপ মা মরনের পর এই বাসার আম্মাই আমারে পালছে।নিজের মাইয়ার মত বড় করছে। তাগো আশীর্বাদ না নিয়া পালাইয়া যামু,না মন্টু মিঞা নিমক হারামী করবার পারবো না।ফুলি হাতের আঙ্গুলে শাড়ীর আঁচল পেঁচাতে পেঁচাতে বলল,আফা আপনিই এহন ভরসা।

ফুলির কথায় বেশ ভালোয় লাগলো।দুজন মানুষ তাদের নতুন জীবনের শুভ সুচনায় আমাকে সাক্ষী রাখতে চাইছে দেখে নিজেকে একটু দামী দামী মনে হচ্ছে।ফুলি আর ড্রাইভার মন্টু মিঞার ইটিশ পিটিশ কিন্তু আমার দৃষ্টি এড়াই নি।তবু অভিভাবক সুলভ ভাব এনে ফুলিকে জিজ্ঞেস করলাম,
-তা কতদিন হলো তোমাদের ভাব ভালেবাসার??
-এইতো আফা গত বছরেই তো। এই ধরেন গত ইদের জুম্মার পরের জুম্মা,,, না তার পরের জুম্মা,,,
ফুলি তার মাথা খোঁচাতে লাগলো।
-কি বল প্রথম প্রপোজ ডেট মনে নাই।
-মানে মন্টু মিঞা তোমারে কোনদিন লাভিউ বলছে ভুলে গেছ?
-ধুর আপা শরমের কথা।
ফুলির গাল লাল হয়ে গেছে।
-আচ্ছা মন্টু মিঞার সম্বন্ধে ভালো মত জানো তো!!
-আফা আমার থিকা আপনারাই তো ভালো জানেন মন্টু মিঞা কত ভালা মানুষ!!কোন দিন একটা টাকা মাইরা খাইনাই।
-হুম কথা সত্য।মন্টু মিঞার এই দিকটা ভালো।
-আচ্ছা ঠিক আছে আগে মন্টু মিঞার সাথে একান্তে বৈঠক হবে তারপর।

সেদিন নাশতার টেবিলে খানিক উশখুশ করতে করতে ফুলি আর মন্টুর বিয়ের কথা বলেই ফেললাম বাবা মার সামনে।বাবা আমার কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন।
-ফুলি আর মন্টু মিঞার প্রেম।বাহ্ ব্যাপারতো বেশ ইনটেরেস্টিং।তা কতদিন ধরে।
মা স্বভাবসুলভ মেজাজটা গরম করে। শুরু করলেন পঁচানী দেয়া।
-তোরে কে বলছে ওদের হয়ে কথা বলতে।আমার ঘরে এসব ইটিশ পিটিশ একদম চলবেনা।কই ফুলি?
এদিকে আয়। দেখি তোর রংঢং কোন দিকে বাড়ছে।

বাবা সন্তর্পণে এক টুকরো রুটিতে ভাজি পুরে মুখে নিতে নিতে বললেন,

-আহা তুমি অত রাগ করছ কেন!!দু জন প্রাপ্ত বয়স্ক মানব মানবী নিজেদের মধ্যে মন দেয়া নেয়া করেছে এখানে তো দোষের কিছু দেখছি না।আরে তুমি দেখছি ভুলেই গেছো।বিয়ের আগে তোমার আমার কি হুলস্থূল প্রেম ছিল।অতঃপর বিবাহ।

মায়ের মেজাজ বিগড়ে দেবার জন্য বাবার কথায় যথেষ্ট। আমি আস্তে করে খাবারটা শেষ করে।গুটি গুটি পায়ে রান্না ঘরে চা বানাতে গেলাম।
নাহ আম্মার হাতের চা কপালে নাই।নিজেকে মায়ের মেজাজের উত্তাপ হতে রক্ষা করতে লক্ষী মেয়েটি হয়ে নিজের চা টা নিজেই বানিয়ে নিলাম।বাবার মার জন্য ও দু কাপ রংচা করে নিলাম।

ভালোই হলো। ফুলির জন্য পুর্বেই ব্যবস্থা করে রেখেছি।ওকে পাঠিয়ে দিয়েছি আমার বেস্ট ফ্রেন্ডে মিলির বাসায়।আজকের দিন বেচারী ওখানেই থাকুক।মার মাথা ঠান্ডা হলেই নিয়ে আসা যাবে।ভাবছি, ভাইয়া আর আপাকে ও ভেড়াতে হবে এই দলে।অবশ্য বাবা যেখানে রাজি সেখানে খুব একটা বেগ পেতে হবে বলে মনে হলো না।

অতঃপর মাকে বোঝাতে সক্ষম হলাম মিঞা বিবি রাজী তো কেয়া কারেগা কাজী।ফুলির বিয়ে নিয়ে আমার মধ্যে অন্যরকম উত্তেজনা বিরাজ করছে।ফুলির বয়স যখন মাত্র পাঁচ ওর মা তখন মারা যায়।ফুলির মা আমাদের বাসায় ছিল এক যুগের ও বেশি কিছু সময়।মা মারা যাবার পর ফুলী থাকতো নানীর কাছে।ফুলির নানী ও এ বাসায় আসা যাওয়া করত।ফুলীর দশ বছর বয়সে সেই নানী ও মারা যায়।আর সেই থেকে ফুলি এই পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ফুলীর বয়স এখন বিশ বছর।মন্টু মিঞারও এ বাড়ীতে চাকরীর বয়স প্রায় দশ বছর হয়ে গেল। ড্রাইভার কাম কেয়ার টেকারের সব কাজে মন্টু মিঞায় ভরসা।বয়স ত্রিশের কোঠায়।বাবা মা আর দুই বড় ভাই, ফুলি আর মন্টু মিঞা এই নিয়েই আমাদের কমপ্লিট সংসার।

পরিবারের বাবারা সাধারণত রাশভারী হন,আর মা রা সারাদিন খেটেখুটে মরা অবলা টাইপ।এ দিক দিয়ে আমার বাবা মার ক্যারেক্টার পুরাই বিপরীত।
বাবা ভীষণ রসিক এবং গোবেচারা একজন মানুষ।আর মা একটু বদমেজাজী। তার বুকে যে স্নেহ মমতার বিশাল কারখানা আছে সহজে তা কাউকে বুঝতে দিতে চান না।আমি কিন্তু সহজেই টের পেয়ে যায়।এই ভদ্র মহিলা কোন এক অজানা কারণে আমার অহেতুক আবদারও মেনে নেন। বড় আপা ভাইয়াও তাই তাদের উদ্দেশ্য সাধনে আমার কাছে এসে মিউ মিউ করে।

ফুলী মেয়েটাও এ পরিবারের বেশ আপন।পরিবারের কার কি পছন্দ অপছন্দ।সকাল সন্ধ্যায় কে কি খেতে পছন্দ করে সবই তার নখদর্পনে।

বড় আপা একটু বেশিই আতেল টাইপ।সারাদিন বইয়ের পাতায় মজে থাক।আমার ভোর সকালের আরামের ঘুমটাই ভাংগে এই বড় আপার আকাশ বাতাস কাপিয়ে পড়া মুখস্ত করার আওয়াজে।
আমার মনে হয় বড় আপাকে যদি জিজ্ঞেস করি সকালে কি খাইছ তা ও বলতে পারবেনা ঠিকমত।

আমি পুরোদস্তুর বড় বোনের বিপরীত পড়াশোনা একদম ভালো লাগে না।আমার বরং জীবনটাকে নিজের মত করে উপভোগ করতে ভালো লাগে।কিন্তু নিজের মত সময় কাটাবো সেই অবস্থা ও নেই।যেখানেই যেতে চাই বাবা মা একা ছাড়বেন না।আবার এই সংসার ফেলে ও যাবে না কোথাও।তার উপর আমাকে চোখে চোখে রাখতে কেন যেন উনাদের বেশ ভালো লাগে।

তাই বিনোদন নিতে ঘরটাকে সারাদিন মাথায় তুলে রাখি। বড় আপাকে মাঝে মাঝে ভয় দেখানো আমার অতিব প্রিয় কাজ।

ফুলিটা আমার এসব অকাজে বেশ ভালো সাপোর্ট দেয়।একদিন করলাম কি বড় আপার বইয়ের ভাজে একটা মরা তেলাপোকা গুজে দিলাম।অমনি তার প্রাণ যাবার যোগাড়।দুষ্টামিটা সেদিন বেশিই হয়ে গেছিল।বড় আপা তেলাপোকা দেখে অজ্ঞান হয়ে গেল।সেই থেকে তাওবা করেছি এ মেয়েকে ভয় দেখানো যাবে না।

ওর আতেল স্বভাবটা দুর করার জন্য কতবার বইয়ের পাতায় প্রেম পত্র গুজে দিলাম।কোন কাজ হলো না।
কিভাবে যেন মেয়েটা আমার লেখা বুঝে ফেলে।
পাড়ার বড় ভাই রুপম যে আপাকে পছন্দ করে আপা
তা জেনেও কেন যে তাকে উপেক্ষা করে আল্লাহ জানে।

রুপম ভাই ঠিক আপার মত আতেল না।একটু আমি আমি টাইপ।আমার সাথেই বরং বেশ মানাবে।কিন্তু এসব কথা কিভাবে বলি।আমি তো আর আট দশটা মানুষের মত স্বাভাবিক না।

ফুলির বিয়ে দিয়েই ভাবছি বড় আপাকে নিয়ে লাগবো।ওর জন্য একটা আতেল টাইপ পাত্র যোগাড় করব।তারপর দুই আতেল মিলে বিয়ের রাতে ও মন দিয়ে পড়াশোনা করবে।

আমার বড় ভাই রিটনটা হয়েছে ভবঘুরে।সারা বছরই দেশান্তরী থাকে।তার দেখা পাওয়া দায়।ট্যুর থেকে ফিরে বাবার টাকায় কেনা ডিএসএলআ দিয়ে তোলা সুন্দর সুন্দর ছবি দেখিয়ে আমার মনটা খারাপ করতে যেন ওর ভালোই লাগে।ও যত আগ্রহ নিয়ে ছবি দেখায় আমার তত জায়গাগুলিতে যাওয়ার তৃষ্ণা বেড়ে যায়।

ভাইয়াকে কতবার বলি,প্লীজ আমাকে এবারের ট্যুরে নিয়ে যা।ওর একটায় কথা, নারে তুই ট্যুরের ধকল সইতে পারবিনা।ভালো মত সুস্থ হলেই সবাই মিলে একটা জম্পেশ ট্যুর দিব।

এরা কেন যে বুঝে না।ইদানিং দম বন্ধ বন্ধ লাগে।ইচ্ছে করে কাধে একটা ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।ভাইয়ার মত দেশান্তরী হই।

ভাবছি ফুলির বিয়েটা হলেই বাবা মার কাছে বায়না ধরব যেন পরিবার সমেত বান্দরবান যাওয়ার ব্যবস্থা করে।

মন্টু মিঞা ইদানিং আমার সামনে পড়তে লজ্জা পায়।বাড়ীর জামাই জামাই একটা ভাব চলে এসেছে তার মধ্যে।
ফুলিরও ইদানিং কাজ কর্মে মন নাই। সারাদিন আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজের চেহারা সুরত দেখতে থাকে।
রান্নাঘর থেকে মা ডাকলেই দৌড় দেয়।
আমার বেশ মজাই লাগে ওদের এমন পাগলামি গুলো দেখতে।
সে দিন তো ওকে দেখে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাবার জোগাড়।মন্টু মিঞা নাকি তাকে লালা লিপস্টিক কিনে দিয়েছে, লিপস্টিকটা এমন ভাবে দিয়েছে ঠোটে যে ঠোটের বাইরেও ছড়িয়ে গেছে।

মেয়েটার মধ্যে অন্যরকম মায়া আছে।সুন্দর মায়াবতী মেয়েগুলোকে আল্লাহ কেন যে এতিম করে দেয় কে জানে!!

আরেকদিন ফুলি কোথা হতে যেন ঐশ্বরিয়া রায়ের বিয়ের ছবি এনে আমার হাতে দিয়ে বলল,
আফা মন্টু মিঞা বলছে বিয়ের দিন আমি যেন এই বেডির লাহান সাজি।সে আমারে স্নো পাউডার কিইন্ন্যা দিব।
তাই নাকি ফুলি!!তুই চিন্তা করিস না।তোকে ঐশ্বরিয়ার থেকেও সুন্দর করে সাজিয়ে দিব।

ফুলিকে বিয়েতে খুব সুন্দর করে সাজাতে হবে।একদম আমার মনের মত করে ফুলিরও যেন নিজের প্রতিবিম্বে চোখ আটকে যায়, যেন মন্টু মিঞা চোখ না সরে।ইতোমধ্যে আম্মার আলমারী থেকে চুরি করে পাঁচটা পা্ঁচ রংয়ের শাড়ি এনেছি।রুমের দরজা বন্ধ করে একটা দুটো করে শাড়ি ট্রায়াল দিচ্ছি।বর আপাকে যত বলি দেখ তো আপা ফুলিকে এই রংটায় কেমন বউ বউ লাগছে।বড় আপা বিরক্তি মুখ নিয়ে দেখে ” সুন্দর” বলেই মুখ ফিরিয়ে নেয়।
এই মেয়েটার মধ্যে যে কবে রসকষ বোধ ঢুকবে আল্লাহ জানে।

আজ পৌষ মাসের চার তারিখ।যথারীতি ফুলির বিয়ের দিন চলে এলো।বড় আপার পরীক্ষার জন্য ফুলির বিয়ের আয়োজন এক মাস পেছানো হয়েছিল।
গত একমাস ধরে ফুলির বিয়ের শাড়ী গহনা,মন্টু মিঞার পাঞ্জাবি, সংসারের খুটিনাটি কেনাকাটা সব কিছু নিয়ে ভীষণ দৌড়ের উপর ছিলাম।দৌড়াতে দৌড়াতে নিজের অসুস্থতার কথায় ভুলে গেছি।ভুলে গেছি সীমাবদ্ধতাার কথা।
বাসার ছাদেই আজ মন্টু মিঞা আর ফুলির বিয়ের আয়োজন চলছে।আমার কাছের কজন বন্ধু স্টেজটা সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে।
মন্টু মিঞা বিয়ের দিনেও সব কাজে হাজিরা দেয়ার চেষ্টা করছে।মন্টু মিঞাকে বারবার মনে করিয়ে দিতে হলো আজ তোমার শুভ বিবাহ।কাজ কাম বাদ।আমাদের ফুলিও বধু সাজে রেডি।ফুলিকে অসাধারণ লাগছে।
সাউন্ড বক্সে, ” লীলাবালি লীলাবালি গান বিয়েবাড়ির পরিবেশটা মাতিয়ে তুলেছে।
জনা পঞ্চাশেক মানুষের দাওয়াত দেয়া হয়েছে। নাচ গানে বিয়ে বাড়ি বেশ জমজমাট।

ফুলি একটু পরপর চোখ মুচছে।ফুলির কান্না দেখতে এখন একদমই ভালো লাগছে না।
আমি গিয়ে একটা ধমক দিলাম।
-একদম কাঁদবিনা কিন্তু।কাঁদলে ভুতের মত লাগবে।
ফুলি এবার আমাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল।নাহ মেয়েটা আমাকে না কাঁদিয়ে ছাড়বে না দেখছি।
-আপা আপনি যা করছেন আমাগো লাইগা, এ ঋণ কেমনে শোধ করুম আপা? আপনি মানুষনা, ফেরেস্তা!
এর উত্তরে কি বলব কথা খুজে পাচ্ছি না।
-আপা আপনি গিয়া রেস্ট নেন।আপনার অনেক বিশ্রাম দরকার আফা।
মন্টু মিঞা ফুলির হাতটা শক্ত করে ধরেছে।আমি কাজের বাহানায় চোখের জল লুকাতে উঠে পড়লাম তাড়াতাড়ি।বাবা মাকে ধন্যবাদ জানানো দরকার।ওদের দুজনকে একসাথে করতে পেরে বেশ ভালো লাগছে।নিজের না পাওয়া স্বপ্নগুলো মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে নাই হয়ে গেছে।
বাবা,মা,আমার সব ইচ্ছায় ইদানিং পুরণ করেন।হয়ত আমার এই বড় অসুখটার জন্য।আমার ভেতর থ্যালাসেমিয়া বাসা বেঁধেছে গত পাঁচ বছর ধরে।
প্রতি মাসেই রক্ত নিতে হয়।জানিনা কতদিন বাঁচবো আর।তবে আমার প্রতি সবার অতিমাত্রায় আদরে মনে হয় বেশিদিন সময় নেই হাতে।

ছাদের এক পাশে চিলেকোঠার দু কামড়ার ঘর।এখানেই বাবাকে বলে ফুলি আর মন্টু মিঞার সংসার জীবনের শুরুর দিককার গল্পটা সাজিয়ে দিয়েছি।ওদের গল্পেটা শেষ পর্যন্ত সুন্দর হোক এই আশাতেই মনে মনে দোয়া করলাম।

আমার মাথাটা আর কাজ করছে না।অবসাদগ্রস্ততা জেকে বসছে।তবে কি আমার দিন ফুরিয়ে এলো।
জানি না।জন্মের পর থেকেই তো এই অসুখটার সাথে লড়ছি।বাবা মা না বললেও আমি জানি এ রোগ যাদের হয় তারা বেশিদিন বাঁচে না।
মানুষের জীবনটা কেন যে এত ছোট হয় জানি না।আমার এখন মরণের পা ছুয়ে নিজের জীবনটা ভিক্ষা চাইতে ইচ্ছে করছে।জীবনের বরাদ্দ দিনগুলি বুঝি শেষ হয়ে এলো।
আচ্ছা আমার বুঝি আর স্বপরিবারে বান্দরবান যাওয়া হলো না।
মেঘ গুলোকে ছুয়ে দেখা হলো না।
দাওয়াত দেয়া অতিথির সবাই এলো। বন্ধু বান্ধবের ভীড়ে রুপমটা কেন যে এলো না।আচ্ছা থ্যালাসেমিয়া তো ছোয়াচে নয়।তবে সোহম কেন দুরে দুরে থাকে?কেন আমাকে এড়িয়ে চলে?
এই মুহুর্তে মাথায় হাজারো এলোমেলো চিন্তা উকিঝুকি দিচ্ছে।একজন একজন করে পরিবারের সবার চেহারা ভেসে উঠছে।

আচ্ছা ফুলি নামের মেয়েটা কি আমাকে মনে রাখবে আজীবন?মনে রাখবে কি মন্টু মিঞা??
বড় আপাকি এ জীবনে ও রোমান্টিক হবে না।
বড় ভাইয়া যে বলেছিল, সুস্থ হলেই স্বপরিবারে বান্দরবান যাব।আমি কি এবারের মত সুস্থ হতে পারব।

আমার কেন যেন ভীষণ স্বার্থপর হতে ইচ্ছে করছে।ফুলীর মত লাল বেনারসী পড়ে লাল টুকটুকে বউ সেজে সোহমের সাথে মেঘের ভেলায় চড়তে ইচ্ছে করছে।ইচ্ছে করছে ঐ যে ঐ গানটা গলা ছেড়ে গাইতে বনমালী তুমি পরজনমে হইয়ো রাধা,,,,,, ইচ্ছে করছে,,,,,ইচ্ছে করছে,,,

লেখকঃ কবি, সাহিত্যিক ও ব্যাংকার, অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড

 

আরও পড়ুন