Ads

পাঠ পরিক্রমা: বাংলাদেশে ইসলাম

আল মারুফ

স্যার হার্বাট রিজলে ১৮৯০ সালে journal of the Anthropological institute এর পত্রিকায় The Study of Ethnology in India নামক একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন।যার বিষয় বস্তু ছিলো বাঙালি মুসলমানদের দৈহিক বৈশিষ্ট্য ও তাদের উদ্ভব তত্ত্বের বিবরণ।প্রবন্ধটিতে তিনি উপমহাদেশের মানুষগুলোকে দৈহিক বিবেচনায় সাতটি ভাগে বিভক্ত করে তা চেনার জন্য নৃতত্ত্ব জ্ঞানের Criteria বা মানদন্ড অনুসরণ করেন।এগুলো হলো

১,তুর্কীয়-ইরান
২ ভারতীয় আর্য
৩,আর্য-দ্রাবিড়৷
৪ শক্-দ্রাবিড়
৫ দ্রাবিড়
৬ মোঙ্গল-দ্রাবিড়
৭ মোঙ্গলীয়।

Criteria অনুযায়ী সাঁওতালরা হলো দ্রাবিড় ভুক্ত এবং দ্রাবিড় ও মোঙ্গলীয় সংমিশ্রণে মোঙ্গল-দ্রাবিড় গড়ে উঠে। যার অন্তর্ভুক্ত হলো অধিকাংশ বাংলার মুসলমান।অর্থাৎ মুসলমানদের একটা বিরাট অংশ হলো মোঙ্গল-দ্রাবিড়। যা কিনা আবার নিম্নবর্ণের হিন্দুরাও এর অন্তর্ভুক্ত।

আবার তিনি Nasal Index বা নাসাক্রমের উপর ভিত্তি করে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের কে আর্য ভুক্ত করেন এবং সার কথায় এটা বলার চেষ্টা করেন মুসলমানদের একটা বড়ো অংশ উদ্ভব হয়েছে নিম্ন বর্ণের হিন্দু থেকে।

প্রবন্ধটি প্রকাশের পর শিক্ষিত মুসলমান সমাজে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।কারণ গবেষণাটি ছিলো ইতিহাস বর্জিত, দুর্বল পর্বেক্ষণ ও সীমাবদ্ধতায় ভরপুর।এই প্রবন্ধটি একটি বিশেষ অঞ্চলের মাত্র ১৮৫ জনের তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে রচিত হয়েছে। অপর দিকে হার্বাট রিজলে গবেষণাটি প্রস্তুতের জন্য সরেজমিনে জরিপ পরিচালনা না করে তার সহকর্মী কুমুদ বিহারী সামন্ত’র মাধ্যমে সম্পন্ন করেন।

এই প্রবন্ধটির সমালোনা করে মুর্শিদাবাদের নবাবের দেওয়ান খন্দকার ফজলে রাব্বি ফারসিতে একটি বই লিখেন।যা ১৮৯৫ সালে Origin of the Musalman’s of Bangla নামে ইংরেজিতে অনুদিত হয়।

ফজলে রাব্বি রিজলের সমালোচনা করে যথার্থতার সাথে তার সীমাবদ্ধতাগুলো তুলে ধরেন।তিনি দেখান রিজলের গবেষণাটি ছিলো ইতিহাস বর্জিত এবং রিভারলি নামক এক আই, সি, এস ভদ্রলোক দ্বারা প্রভাবিত।পরবর্তীতে ফজলে রাব্বিকে কুমুদ বিহারী বলেন, আমাকে সে সব মুসলমানদের মাথা ও নাকের মাপ নিতে বলা হয়েছিলো যাদের সাধারণত দেখেই বুঝা যায় এরা মোঙ্গলীয় ধারায় প্রভাবিত।রিজলের পর অনেকে বাংলার মুসলমানদের নৃতত্ত্বের পর্যবেক্ষণিক পর্যালোচনায় মোঙ্গল ও দ্রাবিড়ের সংমিশ্রণের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।কারণ দ্রাবিড়দের মাথা লম্বা, মোঙ্গল দের চোখের পাতায় ভাঁজ থাকে,গোঁফ-দাড়ি কম এবং চুল খড়খড়ে। অথচ এই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের মাথা মাঝারি,গোঁফ-দাড়ির প্রাচুর্য রয়েছে এবং চুল খড়খড়ে নয়।অর্থাৎ খুব কম সংখ্যক মুসলমানদের মাঝেই মোঙ্গলীয় প্রভাব রেখেছে।

আবার রক্তের বিভাজন নিয়েও এই বিষয়ে নৃতাত্ত্বিক পর্যালোচনা হয়েছে।জার্মানের ম্যাক ফারলেন নামক একজন ইহুদি নৃতাত্ত্বিক মহিলা কলকাতার কাছে বজবজ থেকে মাত্র ১২০ জন মুসলমানের রক্ত নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে বলার চেষ্টা করেন বাঙালিদের নিম্ন বর্ণের হিন্দু ও মুসলমানের রক্ত একই প্রকারের।পরবর্তীতে দিলিপ কুমার সেনের গবেষণায় দেখা যায় বাঙালি মুসলমানদের রক্ত যতটা না নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের সাথে মিল রয়েছে তার চেয়েও উচু বর্ণের হিন্দুদের সাথেই বেশি মিল রয়েছে।

আসল কথা হল ইসলাম কোনো একটা বিশেষ মানব ধারার (Race) ধর্ম নয়।এটা বিশ্বজনীন ব্যবস্থা।এর ঐক্য রক্তের নয়,জীবন রীতির (Way of Life)।সুতরাং এই উম্মার উদ্ভবের তথ্য উদঘাটন কেবল নৃতাত্বিক পর্যবেক্ষণই যথেষ্ট নয় বরং ঐতিহাসিক পর্যালোচনা অপরিহার্য।

এবনে গোলাম সামাদ স্যার এই কাজটিই করেছেন। তাঁর “বাংলাদেশে ইসলাম” বইটিতে এই ভূখন্ডে মুসলমানদের উদ্ভবের কারণ দেখাতে গিয়ে নৃতাত্ত্বিকতার পাশাপাশি ঐতিহাসিক পর্যালোচনাও করেছেন।

৭৫০ থেকে ১০৭৫ সাল পর্যন্ত ছিলো পাল বংশের রাজত্ব।তারা ছিলেন ধর্মে বৌদ্ধ।এরপর দক্ষিণাত্য থেকে আসা সেন বংশের রাজত্ব শুরু হয়।আর তারা ছিলেন গোঁড়া হিন্দু।এরাই বাংলার সমাজে বর্ণপ্রথার উদ্ভাবক।সে সময় উঁচু বর্ণের হিন্দু সমাজে বৌদ্ধদের Unclean বা অশুচি মনে করা হতো।সমাজিক এই নিগ্রহের ফলে ইসলামের সাম্যের বাণী শুনে তারা প্রলুব্ধ হন এবং বৌদ্ধদের একটা বড় অংশ ইসলাম কবুল করেন।

শুধু নিগৃহীত বৌদ্ধরাই নয় বরং আরব বণিক,দ্বীন প্রচারক ও মধ্য এশিয়ার তুর্কি মানবধারার একটা বড় অংশ এদেশে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন।এছাড়া Birth rate বা জন্মহার অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি।উক্ত পর্যালোচনায় এটা স্বীকার্য বাংলার মুসলমানদের উদ্ভবের পিছনে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সংখ্যা নিতান্তই কম।বরং এখানে অনেকগুলো ফ্যাক্টর জড়িত।

তিনি বইটিতে বাঙালি মুসলমানদের মানস বিবর্তনের রুপ-রেখা দেখাতে গিয়ে উনবিংশ শতাব্দীর পরের ঘটনা টেনে আনেন।এ ছড়াও মরমীবাদ ও শরিয়তী ইসলামের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণও করেন।সুনীতি কুমার চট্রোপাধ্যায় দেখাতে চান, মুল ইসলামের সাথে নাকি সুফিবাদের সম্পর্ক ছিলো অল্প।বরং এর সাথে বহুবিদ সহিস ছিলো এদেশের সনাতন যোগমার্গ সাধনার।

যার ফলে এখানে অতি সহজে ইসলাম প্রচারিত হয়েছিল।এবনে সামাদ এ বিষয়ে সুনীতি’র সমালোচনা করেন।এটা সত্য এদেশের আনাচে-কানাচে মাজার,খানকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এবং এই পদ্ধতিতে কিছুটা ইসলামের বিকৃত রুপ প্রকাশ পেয়েছে।তবে তার impact যথাসামান্য।এছাড়া এটা কোনো আঞ্চলিক সমস্যা নয় বরং বিশ্বব্যাপি।যার ফলশ্রুতিতে খণ্ড বিখণ্ড বেশ কিছু বিভিন্ন প্রান্তে শুদ্ধি আন্দোলনও গড়ে উঠেছিলো।

তিনি দেখাতে চেষ্টা করেছে সনাতন যোগমার্গ সাধনা ও প্রকৃত সুফিবাদের মাঝে রয়েছে বিস্তর ফারাক।অন্য মরমীবাদীরা থাকতে চেয়েছেন অবিবাহিত এবং পালন করতে চেয়েছেন ব্রহ্মচর্য ব্রত।কিন্তু সুফিরা ছিলেন বিবাহিত,জন ও সমাজচিন্তক এবং আধুনিক মনস্কো।ইমাম গাজ্জালী’র ভাষায় এদের উদ্দেশ্য হলো অপরের সাথে সংঘানহীন নিস্বার্থ জীবন-যাপন।তাঁরা শুধু জীবাত্মার সাথে পরমাত্মাের সম্বন্ধ স্থাপনের কথাই চিন্তা করেন নি বরং প্রয়োজনে অস্ত্রও তুলে নিয়েছেন।সব মিলিয়ে বইটিতে বহুমাত্রিকতা স্থান পেয়েছে।

পাঠ-পরিক্রমাঃ বাংলাদেশে ইসলাম
এবনে গোলাম সামাদ
পরিলেখ প্রকাশনী
মূল্য ২০০
পরিক্রমায় আল মারুফ,প্রাবন্ধিক, কবি ও সাহিত্যিক

আরও পড়ুন-

হার্ভার্ডের মতো একটি প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশে হবে কি?

রকমারিতে বাংলাদেশে ইসলাম

আরও পড়ুন