Ads

এক জীবন

সাদিকা সুলতানা লীনা

গ্রামের নাম মহেশ্বরী।ছোট্ট গ্রাম;অন্য গ্রামগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন এক জনপদ বলা চলে। আশেপাশে শুধু সবুজ ধানক্ষেত আর গ্রামের মেঠোপথ ছাড়া আর তেমন কিছুই চোখে পড়েনা। তবে গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট একটি নদী। নদীর নাম হাঁড়িধোয়া।গ্রামে মানুষের বসতিও কম। তবে সবার সাথে সবার সম্পর্ক হৃদ্যতাপূর্ণ।
এই গ্রামেরই এক বাসিন্দা আম্বিয়া বিবি৷ বয়স প্রায় আশি ছুঁই ছুঁই;বয়সের আধিক্য এতোটুকুও ন্যুব্জ করতে পারেনি বুড়িকে।বরং পুরো গ্রামময় ঘুরে বেড়ান। গ্রামের সকলেরই কাছে পরিচিত;কেউ দাদী,কেউ চাচী,কেউ বুড়ি মা,কেউ বড় মা বলেও ডাকে। বাচ্চাদের কাছে বেশি জনপ্রিয় আম্বিয়া বিবি। নিজের চারকূলেও আপন বলতে কেউ নেই। অনেক বছর আগে যখন এই গ্রামে বউ হয়ে এসেছিলেন তখন বয়স কতোই বা হবে??৯/১০বছরের বেশি হবেনা। বিয়ের কয়েকবছর ভালোই সংসার করেছিলেন আম্বিয়া বিবি। বিয়ের কয়েক বছর এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন।রাজপুত্তুরের মতো চেহারা ছিল আম্বিয়া বিবির পুত্রের। কিন্তু বুড়ির কপাল মন্দ। সেবার গ্রামে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেড়ে ছিলো;আশেপাশের গ্রামগুলোতেও ম্যালেরিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। কতো মানুষ মরেছিল সেই ম্যালেরিয়ায়। বুড়িও কম চেষ্টা করেননি ছেলেকে বাঁচানোর;কিন্তু বিধি বাম ছিল যে। পারেননি বাঁচাতে সেই সোনার টুকরোর ছেলেকে।ছেলের মৃত্যুর কয়েকদিন পরেই নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন বুড়ির স্বামী চাঁন মিয়া।ওই যে উজানতলীর গঞ্জে গিয়েছিলেন নতুন ব্যবসার খোঁজে আর ফেরেনি।বুড়ি কতো খবর নিয়েছিলেন গ্রামের মানুষদের নিয়ে, কিন্তু কেউ কোন খবর এনে দিতে পারেননি। এভাবেই কেটে গেলো অনেকগুলো বছর। স্বামীর সেই ছোট্ট ভিটেটুকু ছেড়ে আজও কোথাও যাননি। গ্রামের ছেলেপুলেদের নানা কিসসা-কাহিনি আর গল্প আর শ্লোক শুনিয়ে তৃপ্তি পান। ছেলেপুলেরাও এই বুড়ির কাছে এসে খুব মজা পায়,কেউ কেউ মায়ের বকুনি খেয়ে এসে বুড়ির আঁচলে মুখ লুকায়। বাচ্চারা কখনো কখনো বুড়ির জন্য বাতাসা,সন্দেশ এনে দেয়;ভারী মন ভালো হয় তখন বুড়ির।এই গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোই যেন আম্বিয়া বিবির প্রাণ।
আজ কয়েকদিন ধরে আম্বিয়া বিবির শরীর ভালো যাচ্ছেনা। রাতে ভালো ঘুম হয়না, খেতে পারেননা, মাথায় কেমন যেন একটা যন্ত্রণা করে।কাল রাত থেকে শরীরটা যেন বেশিই খারাপ লাগছে। আজ ঘর থেকে কোথাও বের হয়নি আম্বিয়া বিবি। সারাদিন ঘরেই শুয়ে ছিলেন। বিকেলের দিকে পাশের বাড়ির রশিদের বউ এসে খবর নিয়ে গেছে। বাচ্চারা আজ কেউ দেখতে আসেনি বুড়িকে। বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যে ঘনিয়ে এলো। সন্ধ্যের পরপর বুড়ি অসুস্থ শরীরটাকে সামলিয়ে কোনমতে এসে ঘরের দাওয়ায় বসলেন। বাইরের ফুরফুরে হাওয়ায় নিজেকে কিছুটা হালকা মনে হচ্ছিল আম্বিয়া বিবির।
সেদিন আকাশে নবমীর চাঁদ উঠেছে।বাইরের পৃথিবীতে কি ঘটছে সে খবর রাখার কথা না আম্বিয়া বিবির।একটা ছুঁচো ইঁদুর এইমাত্র বুড়ির পায়ের কাছ দিয়ে চলে গেলো।গাছের পাতাগুলো সব নির্জীব হয়ে আছে।হাওয়া একেবারেই নেই;তবে অনেকক্ষণ পর পর একটু হাওয়া বয়ে যায়।খরার দিনের সন্ধ্যায় শস্যহীন মাঠের মতোই আম্বিয়া বিবির মনটা যেন ধূসর ঝাপসা।হঠাৎ এক ঝলক দমকা হাওয়া এসে কতোগুলো পাতা ঝরিয়ে গেল;বুকের মধ্যে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো আম্বিয়া বিবির। চোখ বন্ধ করে আম্বিয়া বিবি চলে গেল যৌবনের সেই আশ্চর্য উদাস দিনগুলোতে। স্বামী-পুত্র নিয়ে সেই সুখের সংসার, সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকা, সারাদিনের কাজ শেষে ছেলেকে কাছে পাওয়া, স্বামীর সাথে একটুআধটু মান-অভিমান চললেও খারাপ তো ছিলো না দিনগুলো। ভালো করে জীবন শুরু করার আগেই স্বামী-পুত্রকে কেড়ে নিলেন খোদা। না খোদার প্রতি আম্বিয়া বেগমের কোনদিন ই কোন অভিযোগ ছিলো না;তবে আজ কেন জানি মহাবিশ্বের সেই মালিকের প্রতি তীব্র রাগ হচ্ছে আম্বিয়া বেগমের। অতীতের কথা ভাবতে ভাবতে আজ শুধু গুমরিয়ে কেঁদে উঠছেন বয়স্ক আম্বিয়া বিবি। কাঁদতে কাঁদতে কখন যে দাওয়ায় ঘুমিয়ে পড়লেন আম্বিয়া বেগম সে খেয়ালও তাঁর ছিলো না।
আকাশে একটু একটু মেঘ ডাকছিলো। এখন পুরো আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। মস্তো থালার মতো চাঁদের আলোয় পুরো পৃথিবী আলোকিত। মহেশ্বরী গ্রামের উপরও চাঁদের সে আলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী, নদীতীরের সারি সারি সুপারি গাছ সব দেখা যাচ্ছে চাঁদের আলোয়।দূর থেকে ভেসে আসছে ক্লান্ত পথিকের হেরেকন্ঠে গেয়ে যাওয়া গান,মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বাঁদুরের ডানা ঝাপটানো,দাওয়ার অদূরেই ক্লান্ত ভংগিতে বসে আছে একটি কুকুর,একটি ঘুঘু পাখি হঠাৎ হঠাৎ ডেকে উঠছে।প্রসন্ন হাওয়া এসে লাগছে আম্বিয়া বিবির শরীরে। আম্বিয়া বিবি জেগে নেই।ঘুমোচ্ছে, ঘুমোচ্ছে, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আম্বিয়া বিবির। মৃত্যুর সুমেরু সিন্ধু অন্ধকারে বারবার ডেকে উঠছে।
এই কি তবে শেষ ঘুম আম্বিয়া বিবির!!!একটু আগে অকস্মাৎ ডেকে উঠা ঘুঘু পাখিটির একটি পালক খসে পড়লো আম্বিয়া বিবির নিকটেই। আম্বিয়া বিবি তাও টের পেলোনা।

আরও পড়ুন