Ads

বাস্তবের ব্লু বিয়ার্ড: ফেলিক্স ভেইল-১ম পর্ব

সাদিয়া রুম্মান
১ম পর্ব
ফরাসী রূপকথার চরিত্র ব্লু বিয়ার্ডকে হয়তো অনেক পাঠকেরই মনে আছে। বাস্তবেও তেমনি এক ব্লু বিয়ার্ড এর সন্ধান মিলেছে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে।নাম উইলিয়াম ফেলিক্স ভেইল , তবে ফেলিক্স ভেইল নামে সর্বক্ষেত্রে পরিচিত । রুপকথার ব্লু বিয়ার্ড এর মত তার কাজ হলেও চেহারা বা কথাবার্তা অবশ্য তেমন ভীতিকর নয়, তবে তার ভেতরে এক রক্তপিপাসু দানবই বাস করে।

২০১৩ সালে, প্রথম হত্যাকান্ডটির ৫ দশকেরও পরে, এই খুনি গ্রেফতার হয় লুইজিয়ানা থেকে।

বাস্তবের এই ভিলেন এর নাম ফেলিক্স ভেইল। ভেইলকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রবীণতম সিরিয়াল কিলার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। বর্তমানে তার বয়স ৭৭ বছর।

কেন তাকে ব্লুবিয়ার্ড বা মানব মুখোশের আড়ালে থাকা দানব বলছি? তার স্ত্রীরা শুধুই নিখোঁজ হয়! প্রথম স্ত্রী মেরি হর্টন ভেইল ফেলিক্স এর সাথে নৌ ভ্রমণে গিয়ে ডুবে মারা যান, এটা নিছক একটা দূর্ঘটনা, ফেলিক্সের ভাষ্য মতে।সেটা ছিল ১৯৬২ সাল।

দ্বিতীয় স্ত্রী ( কমন ল বিয়ে) শ্যারন হেনসলে হঠাৎ এক অস্ট্রেলিয়ান দম্পত্তির সাথে সমুদ্রপথে বিশ্বভ্রমণে বেড়িয়ে পড়েন, ফেলিক্সের ভাষ্যমতে, সেটা ১৯৭৩ সাল। যদিও সেই ঘটনারও কোন সাক্ষী প্রমাণ নাই।

আরেক স্ত্রী , মাত্র ১৮ বছর বয়সী এনেট ক্রেভার ভেইল মেক্সিকো বেড়াতে যেয়ে আর কোনদিনই ফিরে আসে না!সেটা ১৯৮৪ সালের ঘটনা। তবে খটকার বিষয় হল ভেইলের মতে সে যে বাসস্ট্যান্ড থেকে মেক্সিকোগামী বাসে ওঠে, সেই বাসস্ট্যান্ডটিরই কোন অস্তিত্বই নাই।

এ তো গেল ৩জন স্ত্রীর কথা, ফেলিক্স মোট ৬টি বিয়ে করেছে ষাটের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত৷ বাকি ৩টি বিয়ে খুব দ্রুতই বিচ্ছেদে গড়ায়। সেসব প্রাক্তন স্ত্রীদের মতে,ফেলিক্স ভেইল একজন হিংস্র প্রকৃতির মানুষ, যাকে বিয়ের আগে খুবই চমৎকার মনের মানুষ বলে মনে হত। কিন্তু বিয়ের পর পরই তার আসল রূপ খুব তাড়াতাড়ি ধরা পড়ে যায়, তাই প্রাণ বাঁচাতেই সেই নারীরা বিবাহবিচ্ছেদ করেন। এক প্রাক্তন স্ত্রী, যাকে পুলিশ রেকর্ডে শুধুমাত্র ক্যারোলিন নামে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি ভেইলের গাড়িতে সার্জারির বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও সিডেটিভ ইনজেকশন দেখেন।

ফেলিক্স ভেইল ১৯৩৯ সালে মিসিসিপি স্টেটের মন্টপেলিয়ার অঞ্চলে একটি কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই বেশ মেধাবী,পরিশ্রমী আর স্মার্ট হিসেবে বেশ নজর কাড়ে সবার। ভেইল যখন ক্লাস ফাইভের ছাত্র, তখনই সে একজন ‘স্ট্রেইট এ স্টুডেন্ট’ অর্থাৎ সবগুলো বিষয়ে এ গ্রেড পেয়েছিল, কিন্তু ক্লাসটিচার সেই এক বছরেই পাঁচবার তাকে “দুস্টুমি ও দুরন্তপনার দিকে মারাত্মক ঝোঁক থাকা শিশু ” হিসেবে অন্যান্য শিক্ষকদের কাছে ও ভেইলের মা বাবার কাছে তুলে ধরেন। শুধু স্কুলেই না, বরং অন্যান্য ক্ষেত্রেও ফেলিক্স তার প্রতিভা দেখাতে থাকে। ১৬ বছর বয়সে পুরো ক্লে কাউন্টিতে বছরের সেরা কৃষক এর পুরষ্কার পায় যখন ৫ একর জমিতে ১৩০ বুশেল ( এক বুশেল আমেরিকাতে প্রায় ২৫ কেজি) ভুট্টা ফলায়। ফেলিক্সের বাবা রে ভেইল ও একজন সফল চাষী হিসেবে খ্যাত ছিলেন, কিন্তু সেই দক্ষ বাবাকেও হারিয়ে দেয়ায় বাবা অনেক গর্বিত হয়েছিলেন পুত্রগর্বে। তবে ফেলিক্স ভেইলের মা কিন্তু কিশোর ছেলের মাঝে কিছু অস্বস্তিকর বিষয় লক্ষ্য করেন,যেমন আশেপাশের সমবয়সী মেয়েদের লুকিয়ে লুকিয়ে উত্যক্ত করার প্রবনতা, ফেলিক্সের মা ছেলেকে শাসনও করেন এর জন্য। আরেকটা ঘটনা ফেলিক্সের বোন জানায়, একবার তাদের বাড়ির পোষা বিড়ালটা অনেক গুলো ছানা দেয়, তখন ফেলিক্সের মা সিদ্ধান্ত নেন এতগুলো ছানা বাসায় রাখা যাবে না ( ফেলিক্সের পরিবার মূলত গরুর খামারের ব্যবসা করত, তবে ফেলে না দিয়ে বন্ধু- প্রতিবেশিদের মাঝে দিয়ে দেবে, যদি কেউ পালতে চায়। তখন ফেলিক্স হাসতে হাসতে বাবার বন্দুক দিয়ে গুলি করে বিড়াল ছানাদের মেরে ফেলে, ঘটনার আকস্মিকতা আর নিষ্ঠুরতায় সবাই হতভম্ব হয়ে পড়ে। কিন্তু ফেলিক্সের মাঝে কোন অনুশোচনার ছিটেফোঁটা দেখা যায় না।

পরের বছরই আমেরিকান সেনাবাহিনীতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দেয়, এমনকি পাইলট হবার জন্য এপটিচুড টেস্ট এও শত শত প্রার্থীর মাঝে প্রথম স্থান অধিকার করে। তবে ” ফেলিক্স ভেইল নিয়ম শৃঙখলা মেনে চলার মানসিকতা পোষণ করে না ” এই অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে পড়ে আর সেনাবাহিনীতে কোন পদে নিয়োগ পায় নি।
তবে এতে ফেলিক্স ভেইল বেশি দমে যায় নি, কারণ মাত্র ১৮ বছর বয়সে, হাই স্কুল থেকে পাশ করে বের হবার সাথে সাথেই লুইজিয়ানা স্টেটের গন্ধক ( সালফার) কারখানায় খুবই আকর্ষনীয় বেতনে চাকরি পেয়ে যায়। কাজে দক্ষতা দেখায়, তার সাথে আবার ফেলিক্সের চাচা সুপারভাইজার হওয়ায় অতি দ্রুতই পদোন্নতি ঘটে। খুব
তাড়াতাড়ি দুটি বিলাসবহুল গাড়ি,একটা দামী মোটরসাইকেল আর সাথে মোটরবোটের মালিক হয়,সেই ৫৭/৫৮ সালেই তার বয়সের অন্যান্য ছেলেদের চাইতে ৪/৫ গুণ বেশি উপার্জন ফেলিক্সের তখন। সে সময় প্রচুর মেয়ের সাথে ফেলিক্সকে ঘুরতে দেখা যেত।

১৯৬৯ তার সাথে পরিচয় হয় লুইজিয়ানার অপরুপা সুন্দরী তরুণী মেরি,পুরো নাম মেরি হর্টন। লুইজিয়ানার ইউনিস হাই স্কুলে হোম কামিং কুইন হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিল,তার সৌন্দর্যের প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। মেরি হর্টনের বাবা একজন স্বচ্ছল তুলা ব্যবসায়ী, মা একজন স্কুল শিক্ষিকা। খুবই হাসিখুশি, মিশুক আর কোমল স্বভাবের মেয়ে বলে বিশেষ খ্যাতি ছিল। ছোট ভাই উইলিয়াম হর্টন এক সাক্ষাৎকারে স্মৃতিচারণ করে বলে ” নিঃসন্দেহে মেরি ছিল এক অসাধারণ বোন, এখনো মনে পড়ে আবহাওয়া যখন ভালো থাকত না,আমি বাইরে খেলতে যেতে পারতাম না মেরি আমাকে সারাদিন হার্ডি বয়েজ ( তুমুল জনপ্রিয় কিশোর উপন্যাসের সিরিজ) পড়ে শোনাত আর পপকর্ণ খাওয়াত। কোন ছোট ছেলেরই এমন একটা বড়বোন থাকা স্বপ্নের মত। ”
১৯৬০ সালের দিকে, তখন মেরি ম্যাকনেজ কলেজ থেকে সদ্য গ্রাজুয়েট হয়েছে,ফেলিক্স ভেইলের সাথে পরিচয় ঘটে । ফেলিক্স ভেইল ও তার ৬ ফুট উচ্চতার সাথে গভীর নীল চোখ আর সোনালি চুল ও পেশীবহুল দেহের কারণে সুদর্শন হিসেবে তরুণীমহলে বেশ জনপ্রিয় ছিল। দু’জনেই একে অপরের নজর কাড়ে। শুরু হয় তাদের প্রেমের সম্পর্ক।
চলবে

ছবি পরিচিতিঃ ফেলিক্স ভেইলের তিন স্ত্রী। (বা থেকে) এনেট ক্রেভার ভেইল, মেরি হর্টন ভেইল ও শ্যারন হেইনসলে

লেখকঃ সাহিত্যিক ও নিউ ইয়র্ক প্রবাসী বাংলাদেশি।

আরও পড়ুন