Ads

সমাজে সৎ লোকের অভাবে যেভাবে হারিয়ে যাচ্ছে বিশ্বাস

কাজী মুস্তাফিজ

সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় ছোটবেলা থেকেই আমি বেশ সাহসী। কিন্তু সেই সাহস অন্যায়ের ক্ষেত্রে কাজ করে না। প্রাথমিকে পড়ার সময় আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনের রাস্তায় একদিন এই সাহস দেখিয়েছিলাম। ঘটনা ছিল রাস্তায় দূর থেকে একটি যাত্রীবাহী বাস আসছে। আমি রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। বাসটি যখন একদম কাছে এসে পৌঁছালো তখনই আমি মুহূর্তেই একপাশে সরে গেলাম। এই সাহস দেখিয়েছি ক’জন সহপাঠীকে।

যা হোক, এই লেখা মূলত সাহস নিয়ে নয়। সততা, নৈতিকতা, বিশ্বাস- এসব নিয়ে। নিঃস্বার্থে মানুষের জন্য কিছু করার বিষয়ে। অর্থাৎ এক কথায় বলতে গেলে মানবিকতা নিয়ে। কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা তুলে ধরার মাধ্যমে বিষয়টি পরিষ্কার করার চেষ্টা করব।

আজকাল চারদিকে শুধু দেয়া-নেয়ার বিষয়। অর্থাৎ বিনিময়। কী দিলে কী পাবো। কতোটুকু দিলে কতোটুকু পাবো। কাউকে কোনো বিষয়ে ‘সহযোগিতা’ করলে তার বিনিময়ে আমি কী পাবো- এসব চিন্তা কাজ করে আমাদের ভেতরে। এই চিত্র প্রায় সবখানেই।

শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, “যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ভালোবাসে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ঘৃণা করে, আল্লাহর জন্য দান করে এবং আল্লাহর জন্য (দান করা হতে) বিরত থাকে, ওই ব্যক্তি তার ঈমানকে পরিপূর্ণ করেছে৷” (আহমাদ ও তিরমিযী)।

ঘটনা ১ 
আমার জন্মস্থান ফেনীকে বলা হয় সাংবাদিকতার উর্বর ভূমি। এখানে জন্ম নিয়েছেন বহু প্রথিতযশা সাংবাদিক। তাদের একজন হলেন প্রয়াত গিয়াস কামাল চৌধুরী (জন্ম: ২১ জুলাই, ১৯৩৯ – মৃত্যু: ২৬ অক্টোবর, ২০১৩)। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত কলামিস্ট ও সংবাদ বিশ্লেষক। বিভিন্ন সময়ে একাধিক মেয়াদে তিনি ডিইউজে, বিএফইউজে ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশের একজন কূটনীতিক হিসেবে লণ্ডনস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশর মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর একনিষ্ঠ অনুসারী হিসেবে পকিস্তান আমলে গণতান্ত্রিক ও স্বায়ত্তশাসন অন্দোলনে অংশ নিয়ে বহুবার কারাবরণ করেছেন।

এই মানুষটির মৃত্যুবার্ষিকীতে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক স্মরণসভা আয়োজন করেন ফেনীর সাংবাদিকরা। সেখানে কেউ একজন স্মৃতিচারণ করছিলেন। বললেন, গিয়াস কামাল চৌধুরী বাসা থেকে বাজারের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়েছেন। কিন্তু দেখা গেছে কারো চাকরির তদবির করার জন্য সচিবালয়ে গিয়ে বাজার করার কথা ভুলে গেছেন। ওদিকে তার স্ত্রী বসে আছেন খালি হাতে। জানেন না আজ কী রান্না হবে। এমন পরোপকারী ছিলেন তিনি।

ঘটনা ২
আমার সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দাগনভূঞা আজিজিয়া সিনিয়র মাদ্রাসার ঘটনা। তখন সম্ভবত প্রাথমিকের গন্ডি শেষ করে ফেলেছি। একই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী এক বড় ভাই একদিন রেস্তোঁরায় গিয়ে আমাকে ভালো করে খাওয়ালেন। খাওয়ার মেনুতে ছিল রুটি (তন্দুল রুটি)। সঙ্গে মুগডাল। খেতে বেশ ভালোই লেগেছে। খাওয়া শেষে বের হওয়ার পর একটি প্রেমের চিঠি ধরিয়ে দিলেন আমার হাতে। এটি দিতে হবে আমার একক্লাস জুনিয়র এক মেয়েকে। মেয়েটির বাসাও আমার বাসার পাশেই। কিন্তু আমার মধ্যে ভয় কাজ করছিল। কারণ কোনো শিক্ষকের চোখে পড়লে খবর আছে আমার! সেই বড় ভাই অনেক চেষ্টা করেও চিঠিটি শেষ পর্যন্ত আমার মাধ্যমে পৌঁছাতে পারলেন না।

তখন আমার পরীক্ষা চলছিল। এক পর্যায়ে তিনি হুমকি দিয়ে বলেই ফেললেন তোমার পরীক্ষা দেয়া বন্ধ করে দেবো! আমি খানিকটা ভয় পেয়েছি্। একইসঙ্গে অবাকও হলাম। কারণ তার সম্পর্কে আমার ধারনা অনেক ভালো ছিল। অনেক শ্রদ্ধার পাত্র মনে করতাম। কিন্তু আজ তা ভুল প্রমাণ হলো! বুঝলাম তিনি এতো যত্ন করে আমাকে খাওয়ানোর পেছনে অসৎ উদ্দেশ্য ছিল। সেই থেকে মনে মনে ঠিক করেছি, কারো থেকে বিনামূল্যে এমন কিছু নেয়া যাবে না, যার জের হিসেবে পরে খারাপ কোনো পরিণতি বরণ করতে হয়।

সেই বড় ভাইকে আজ ধন্যবাদ দিতে চাই এজন্য যে, সেদিনের অভিজ্ঞতা না হলে আজ আমি এই লেখায় বিষয়টি উল্লেখ করতে পারতাম না। একজন মানুষও যদি এই লেখা থেকে উপকৃত হয় তবে আমি নিজেকে স্বার্থক মনে করব।

ঘটনা ৩
আগে কিছু কসমেটিক কোম্পানি নানা ধরনের ফ্রি অফার দিতো। এখনো দেয়। এমন একটা অফার ছিল একটি সাবানের। সেটি ছিল এমন যে, ১২টি খালি পেকেট দিলে একটি সাবান দেয়া হবে। তো আমাদের বাসায় আমার মেঝো আপু ও ছোট আপু একটি শো-কেসে সাবানের খালি প্যাকেট সাজিয়ে রাখতেন। টিভিতে ওই কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেখে খুব খুশি হলেন তারা। খালি প্যাকেটগুলো আমাকে দেয়া হলো। আমি দোকানে নিয়ে গেলাম। কিন্তু দোকানি হাতে নিয়ে দেখেন- এগুলো গায়ে লেখা ‘১০০ গ্রাম’ ওজন। বললেন, এগুলো হবে না। যেগুলোর গায়ে ‘৯০ গ্রাম’ লেখা আছে সেগুলো লাগবে। অর্থাৎ তখন বাজারে চলমান পণ্যগুলোর প্যাকেট লাগবে। তার মানে ৯০ গ্রামের ১২টি সাবান কেনার পর আমি ৯০ গ্রামের আরেকটি সাবান পাচ্ছি। কিন্তু ১২টি সাবানের প্রত্যেকটি থেকে ১০ গ্রাম করে ১২০ গ্রাম কেটে নেয়া হলো। এটি হলো প্রতিষ্ঠানটির মার্কেটিং পলেসি বা বিপণণ নীতি। এখানেও গ্রাহকের সঙ্গে সেই ‘নিঃস্বার্থ’ কোনো আচরণ করা হচ্ছে না।

ক’দিন আগে সাইবার সচেতনতা বিষয়ক পাওয়ারপয়েন্ট প্রেসেন্টেশন তৈরি করতে গিয়ে আমি একটি স্লাইডে রেখেছি- ফ্রি কোনো কিছুকে না বলুন। কিংবা ফ্রির কারণ খতিয়ে দেখুন। এরপর সিদ্ধান্ত নেবেন যে, তা গ্রহণ নাকি বর্জন করবেন। কারণ হলো সাইবার অপরাধীরা এমন অনেক কিছু ফ্রিতে দেয়ার কথা বলে ‘ফাঁদ’ পাতে। পরে প্রতারণার শিকার হন সংশ্লিষ্ট ইন্টারনেট ব্যবহারকারী।

ঘটনা ৪
এই ঘটনার কারণেই মূলত এই লেখার ভাবনা মাথায় আসে। অনলাইনে পরিচয় হয় এক আপুর সঙ্গে। তিনি পেশায় ফ্যাশন ডিজাইনার। অনলাইনে থ্রি-পিচ বিক্রি করেন। কিছু দিন আগে আমারও একই ধরনের একটা ব্যবসা ছিল। সেই হিসেবে তার সঙ্গে পণ্য বেচা-কেনার সুবাধে কিছুটা ‘সখ্যতা’ তৈরি হয়।

গত বেশ কয়েক মাস ধরে আমার আর্থিক সংকট যাচ্ছে। নিয়মিত বেতন হবে, এমন প্রত্যাশায় একটি অনলাইন পোর্টালে চাকরি করছিলাম। সেখানকার আর্থিক সংকটের প্রভাব পড়েছে আমার ব্যক্তিগত জীবনে। তবে আমি বিশ্বাস করি, এক দরজা বন্ধ হলে সৃষ্টিকর্তা হাজার দরজা খুলে দেন। কারণ তিনি বলেছেন, “দুনিয়ায় বিচরণকারী এমন কোনো প্রাণী নেই, যার রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহর ওপর নেই। -(সূরা হুদ: ৬)। তারই অংশ হিসেবে হয়তো নতুন করে আবার ই-কমার্সের কাজে হাত দিলাম। কিন্তু পূঁজির অভাব। তাই পরিচিতজনদের কাছে টাকা ধার চাওয়া শুরু করলাম। ফ্যাশন ডিজাইনার ওই আপুর কাছেও কয়েকবার টাকা ধার চাইলাম।

সবশেষ গত ৩১ জুলাই তার সঙ্গে অনলাইনে কথা হচ্ছিল। টাকা চাওয়ার পর বললেন, আমি নিজেই অভাবে আছি। তুমি শুধু টাকার জন্য নক করো। উত্তরে আমি তাকে একটি কৌতুক শেয়ার করলাম।

কৌতুকটি হলো- শিক্ষক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাকে টাকা ও জ্ঞান দেয়া হলে কোনটি গ্রহণ করবে? ছাত্রের সাবলীল উত্তর- ‘টাকা নেবো স্যার’। শিক্ষক বললেন, ‘তোমার জায়গায় আমি হলে জ্ঞান নিতাম।’ এরপর ছাত্র বললো- স্যার, যার যেটা অভাব!

এই কৌতুক শুনে ওই আপু বললেন- মানুষকে দিতে শেখো। উত্তরে আমি দোয়া চেয়ে বললাম, আমিওতো দিতে চাই। আল্লাহ সামর্থ দিক। এরপর তাকে পাল্টা প্রশ্ন করে বললাম, আচ্ছা আপনি এ পর্যন্ত কতোজনকে দিয়েছেন, জানতে পারি? তিনি বললেন- সেটি আমার কাছে বলতে বাধ্য নন। এবং জানালেন এরপর আর আমার সঙ্গে তার কথা হবে না। শেষমেষ আমার আইডি ব্লক দিলেন মেসেঞ্জারে।

মনে পড়ছে, যাকে এতোবার ‘আপু’ বলে সম্বোধন করলাম তিনিও আমাকে ‘ব্যবহার’ করেছেন তার ব্যবসার জন্য। একদিন একটি জামা কিনতে চাইলাম তার ব্যবসায়িক ফেসবুক পেজে ছবি দেখে। বললেন, যে পরবে তার মাপ জানতে হবে। মাপ ছাড়া এই ডিজাইনের জামা দেয়া যাবে না। আমি বললাম তা তো জানা নাই। তিনি বললেন, শুধু উচ্চতা জানলেই হবে, এটুকু জেনে নিতে পারবা না? পরে আমি খোঁজ নিয়ে উচ্চতা জানালাম। কিছু টাকা অগ্রিম দিতে হলো, নয়তো তিনি কাপড় কাটবেন না। এরপর তিনি জামার আরো কিছু মাপ জানতে চাইলেন। কিন্তু সেগুলো আমি জানাতে পারলাম না। শেষে উপায় না পেয়ে বললাম, অন্য মাপগুলো মিডিয়াম সাইজ হিসেবে করে দেন। করে দিলেন। কিন্তু যার জন্য জামা নেয়া হলো তার গায়ে ঠিকমতো হলো না। ওই যে অনুমান করে মাপ দিতে বললাম। তিনি যদি শুরুতেই কী কী মাপ লাগবে আমাকে খোলাখুলি বলতেন, আমি সম্ভব হলে জামা কিনতাম। নয়তো কিনতাম না। কিন্তু তিনি ভাবলেন সব একসঙ্গে চাইলে আমি যদি জামা কিনতে রাজি না হই। অর্থাৎ তিনি নিজের ব্যবসার বিষয়ে সৎ ছিলেন না। অল্প কিছু টাকার জন্য চাতুরতার আশ্রয় নিয়েছেন।

আমাদের সমাজ আজ এমন অসৎ লোকে ভরে গেছে। এ কারণেই কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারেন না। সমাজ থেকে বিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। নিঃস্বার্থ কেউ কারো জন্য কিছু করতে চান না। গিয়াস কামাল চৌধুরীদের জন্ম হচ্ছে না। মহামারী রোগ দিচ্ছেন আল্লাহ!

আত্মসমালোচনার খুব প্রয়োজন
সূরা শূরা’র ৩০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, “তোমাদের যে মুসিবতেই স্পর্শ করুক না কেন তা তোমাদের কৃতকর্মের কারণেই হয়ে থাকে। আর তিনি (আল্লাহ) অনেক কিছুই ক্ষমা করেন।”

বান্দাকে পরীক্ষা করার মাধ্যম হচ্ছে রোগ-ব্যাধি, বিপদ-আপদসহ যাবতীয় কর্মকাণ্ড। মহান রবের পথে অটল থাকার জন্য প্রয়োজন ধৈর্যের এবং মহান আল্লাহ আমাদের প্রত্যেককেই যাচাই করবেন কথা ও কাজের সঙ্গে মিল আছে কি না, তা দিয়ে। এই দুনিয়ার জীবনে মহান আল্লাহ শুধুমাত্র খাওয়া দাওয়া ও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই পাঠাননি। আমাদের জানতে হবে আমার এই মূল্যবান জীবনকে কোন উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়েছে, আমার করনীয় কী, আমাকে আবার নিয়ে যাওয়া হবে মহান রবের কাছে, সেখানে আমি কী নিয়ে দাঁড়াবো?

শেষ বিচারের দিন প্রত্যেককে বলা হবে, “তুমি তোমার কৃতকর্মের ফিরিস্তি পাঠ করো। আজ তুমি নিজেই তোমার হিসাব-নিকাশের জন্য যথেষ্ট। (সূরা বনি ইসরাঈল, আয়াত: ১৪)”

আসুন, আমরা আত্মসমালোচনা করি। ক্ষমা চাই সৃষ্টিকর্তার কাছে। দেশ ও দেশের মানুষের জন্য প্রার্থনা করি।

লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, তরুণ উদ্যোক্তা ও সমাজকর্মী

 

আরও পড়ুন