Ads

শিশুদের জন্য সহশিক্ষা কার্যক্রম কেন দরকার?

মোসা: নাছরিন সুলতানা

পড়াশোনার পাশাপাশি পড়াশোনার বাহিরে শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য যে কার্যক্রম স্কুলে বা স্কুলের বাহিরে করা হয় সাধারন ভাবে একেই সহশিক্ষা কার্যক্রম বলে!

এর প্রয়োজনীয়তা বলে শেষ করা যাবে না! তবুও একটু ব্যাখ্যা দেই আমরা বলি আমার সন্তান পড়াশোনা করে না সারা দিন টিভি, মোবাইল আর গেইমস খেলে! আমি বলব আপনি পড়াতে পারেন না! এটা আপনার সন্তানের নয় আপনার ব্যার্থতা!

কারণ আপনি তাকে পড়ার মজাটাই দিতে পারেন নি! একটা উদাহরণ দেই আশাকরি বুঝতে পারবেন! আমার সন্তানের বয়স ৭ + ও ইংরেজি ভার্সন one এ পড়ে। তাই এদের কাছে সাধারণত বাংলাটা কঠিন এবং পড়তে চায় না! একদিন ওদের অনলাইন ক্লাসে মিস ওদের বাংলা রিডিং পড়তে দিল কেউই ভাল করে পড়তে পারেনি। কেউ বানান করে পড়ে । কেউ সংযুক্ত বর্ণ পারেই না! আমার ছেলের একই অবস্থা। দেখেই মন খারাপ হলো সারাদিন চিন্তা করছি কি করে এটা কাটানো যায়! সন্ধ্যায় হঠাৎ টিভিতে কি যেন একটা খেলনা দেখে ও এসে বলল মা ঐ খেলনাটা কিনে দাও ওটা চাই আমার! তখনই একটা বুদ্ধি এলো! আমি বললাম ঐ খেলনা তুমি তখনি পেতে পারো যদি তুমি একটা গল্পের বই পড়ে শেষ করতে পার! যখন শেষ হবে তখনি পাবে! ও মনে করল এ আর কি কঠিন কাজ রাজি হয়ে গেল। বই দাও আমি ওকে বুকসেল্ফ খুলে বললাম তুমি নিজেই পছন্দ করে নিয়ে নাও। ও বঙ্কিমচন্দ্রের ছোট ছোট গল্পের একটা বই নিয়েছে যেটাতে ১০৪ টি ছোট গল্প আছে! এতো কঠিন বইটি নিয়েছে দেখেও আমি চুপ করে ছিলাম ও কি করে দেখার জন্য । কারণ বইটা ছিল সাধু ভাষার এবং অনেক যুক্ত বর্ণ কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিল যে, যে পারে না তার কাছে সবই কঠিন আর ও যদি শুরুটা কঠিন দিয়েই করে তাহলে সমস্যা হবে না! ওর বাবাও আমাকে বকা দিল এতো কঠিন ভাষার বই কেন দিলাম! আমি শুধু বলেছি এটা ও ওর পছন্দ মতো নিয়েছে আশাকরি পারবে, যদি না পারে ও এসে বলবে মা আমি পারি না । তখন চেইন্জ করব তার আগে না! ওর যাত্রা শুরু… আমাদের সামনে বসে বসে পড়ে যেগুলো পারে না আমি বানান করে করে বলে দেই। একটা গল্প পড়ে আর পেন্সিল দিয়ে দাগ দেয়! প্রতি দিন গল্প পড়ে আর দাগ দেয় বাসায় যে আসে তাকেই বলে গল্প শুনতে ! ছোট ভাইবোন ও বলে ভাইয়া তাড়াতাড়ি শেষ কর তোমার বই পড়া শেষ না হলে মা খেলনা কিনে দিবে না! মিস আসে পড়াতে কিন্তু মিসকে শর্ত দিয়েছে পড়ার পর যদি প্রতিদিন পাঁচটি গল্প পড়া শুনে তবেই পড়বে তাতে মিসও রাজি! এখন তার কাছে টিভি, মোবাইল, গেইমস সবই অর্থহীন! ২৯ দিনে তার ১০৪ টা গল্প শেষ হয় এবং তারা খেলনা পায়! সেটা যে তাদের জন্য কি আনন্দ ছিল আমি নিজেও এতোটা আশা করিনি। ফলাফল হচ্ছে সে এখন ৯০% সংযুক্ত বর্ণ নিজে নিজে পাড়ে রিডিং তো অবশ্যই।

# আরেকদিন কার বাসায় দাবা দেখে এসে বলে মা দাবা কিনে দাও। আমি বললাম তুমি তো এ খেলা পার না দাবা দিয়ে কি করবে! এনে দাও শিখব! আমি মোবাইলে দাবা বের করে দিয়ে বলেছি যেদিন দাবার সবগুলো গুটির নাম বলতে পারবে সেদিন কিনে দিব! ও এখন আমরা সাথে দাবা খেলে এবং ওর বিশ্বাস মাকে একদিন হারাবেই! সে যে একদিন মাকে হারাতে পারবে এটা শুধু আমার নয় আপনারাও বিশ্বাস করেন নিশ্চয়ই!

# প্রতিদিন রং পেন্সিল নিয়ে লেগে থাকে ভাই-বোন মিলে ছোট ছেলের বয়স চার বছর কোন দিন লিখতে বসাতে পারিনি । তাই খাতা আর রং পেন্সিল দিয়ে ভাইবোনদের ছেড়ে দিয়েছি কে কত বেশি আঁকতে পারে এখন ছোট ছেলে নিজে নিজে সব লিখতে পারে!

# গতকাল আমার অফিসে এক শিক্ষক এসেছেন তার সাত বছরের বাচ্চাকে নিয়ে ও চোখে দেখতে পায়না । দেখে একটু খারাপ লাগলেও ওকে ইজি করতে ওর সাথে একটু গল্প করলাম। কিছুক্ষণ কথা বলে সে চুপ হয়ে গেল । আর কথা বলছে না । আমি বললাম কি হলো এটা । ও চুপ হয়ে গেল কেন? স্যার বলল ম্যাডাম এটাও ওর একটা সমস্যা, কেন যে এমন করে? আমার খুব খারাপ লাগছিল যে ও কি আমার কোন কথায় কষ্ট পেল? মনে মনে বললাম ওকে কথা বলাবই! স্যার কে বললাম মিতা তো অনেক সুন্দর ছবি আঁকতে পারে তাই না স্যার? স্যার বলল জ্বী ম্যাডাম আপনি জানলেন কি করে? আমি বললাম হে জানিতো মিতা অনেক সুন্দর ফুল, ফল, গাছ এর ছবি আকেঁ! ও বলে উঠল না না আমি বেশি রংধনুর ছবি আকিঁ! জানেন …….!!! তার পর অনেক কথা আর যেন শেষ হয় না! স্যার মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার সময় প্রায় কান্না করে দিল আর বলল ম্যাম আমার মেয়ে কোথাও গিয়ে এতো আনন্দ পায়নি আজ আপনি যেটা করলেন! আসলে আমি কিছুই জানতাম না আমি জানতাম সব বাচ্চারা রং পছন্দ করে সেও করবে এই এক্টিভিটিসটাই সহ – শিক্ষা যা শিশুদের আনন্দ দিয়ে শিখানো হয়।

এই করোনার সময় অনেক অভিবাবক আছেন যারা মন খারাপ করছেন সন্তানকে স্কুলে দিতে পারছেন না পড়াশোনা পিছিয়ে গেল; কি হবে কি হবে না! তাদেরকে উদ্দেশ্যে করে বলছি দয়া করে এ চিন্তা মাথা থেকে দুর করে দেন। এক বছর না পড়লে কিচ্ছু হবে না। ভেবে দেখুন তো বাংলাদেশে এমন অনেক ছেলে মেয়ে আছে যারা মাষ্টার্স পাশ করে চার পাচঁ বছর বসে আছে; চাকরি পায়না । সেটা যদি অভিবাবক হিসাবে মেনে নিতে পারেন, তাহলে এখন এই সময়ে একটা বিশেষ কারণে আপনার সন্তান স্কুলে যেতে পারছে না; এটা কেন মানতে পারছেন না। প্রাকৃতিক দূর্যোগ কখনো বলে কয়ে আসে না যে আপনি আগে থেকে প্রস্তুত থাকবেন। আপনার তো খুশি হওয়া উচিত এটা ভেবে যে আল্লাহ অশেষ রহমতে আপনার সন্তান বেচেঁ আছে সুস্থ আছে আপনার বুকে আছে! তাই এই সময়টায় যাতে আপনার সন্তান আনন্দে থাকে সে জন্য আপনি সহ শিক্ষার উপর জোর দিয়ে শিক্ষা দিতে পারেন । তাহলে আপনার সন্তান একদিকে যেমন সুস্থ থাকবে অন্য দিকে আনন্দ নিয়ে শিক্ষা লাভ করবে।

আশাকরি আর ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন নেই Co Curriculum Activities কি, এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা কি সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন। আসলে Formal Education কে কার্যকর করার জন্য সহশিক্ষার বিকল্প নেই! একমাত্র সহশিক্ষাই পারে আনন্দ দিয়ে শিশুদের শিক্ষা দিতে। আর সেই শিক্ষাটাই হচ্ছে আসল শিক্ষা।

লেখকঃ কলামিস্ট ও থানা শিক্ষা অফিসার, লালবাগ, ঢাকা।

 

আরও পড়ুন