Ads

ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী নেতাদের গুপ্তহত্যার ইতিহাস

আলী আহমাদ মাবরুর 

ফিলিস্তিনের চলমান মুক্তি আন্দোলন নিয়ে অনেক পোস্ট পাচ্ছি। অনেক ভাই নিয়মিত আপডেটও দিচ্ছেন আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু এ ঘটনার নেপথ্যে যে মানুষগুলো বিগত অনেক বছরে ফিল্ড তৈরি করে গেলেন কিংবা যে ঘটনাগুলো এই আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি করেছিল, তেমন কিছু ঘটনাও সামনে আনা প্রয়োজন বোধ করি। ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাস হুট করে ঘটা কোনো বিষয় নয়। হঠাৎ করেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলো, এমনও নয়। পুরনো ঘটনা প্রবাহগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা মাঝে মাঝে সামনে আনবো ইনশাআল্লাহ।

আজ সেই সব শহীদদের স্মরণ করতে চাই, যারা ইসরাইলী সেনা ও তাদের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেছেন। ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলনের এই সংক্ষিপ্ত উপাখ্যান আমাদের অনুপ্রেরণা করবে। বর্তমানে চলমান সংগ্রামের মাঝেও এই কিংবদন্তীদের যেন আমরা ভুলে না যাই।

এই হত্যাকান্ডগুলোর অধিকাংশই পরিচালনা করেছে ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থার ইতিহাস গুপ্ত হত্যার ইতিহাস। হিব্রু শব্দ ‘মোসাদ’-এর অর্থ ‘সংস্থা’। এই সংস্থার প্রকৃত নাম ‘দি ইনস্টিটিউট ফর ইনটেলিজেন্স অ্যান্ড স্পেশাল অপারেশনস’। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী সরাসরি মোসাদ পরিচালনা করেন। সংস্থাটির সদস্যসংখ্যা এবং তাদের পরিচয়ও প্রকাশ করা হয় না। তবে মোসাদের পরিচালকের পরিচয় প্রকাশ করা হয়।

১৯৪৯ সালে মোসাদের জন্ম হলেও দীর্ঘদিন পর্যন্ত কেউই জানতোনা এই সংস্থার প্রধান কে বা কারা এটা পরিচালনা করে। ১৯৯৬ সালে ড্যানি ইয়াতম মোসাদের দায়িত্ব নেয়ার পর সকলে এ সংস্থা এবং এর কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে পারে। কিডনাপ ও গুপ্তহত্যায় মোসাদ বিশ্বে অদ্বিতীয়। ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেনগুরিয়ান এই সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা। মোসাদের বেশীরভাগ লোকই সাবেক সন্ত্রাসী সংগঠন হাগানাহ, ইরগুন, স্টানগেগ এর লোক।

গুপ্ত হত্যা করার জন্য কাউকে চিহ্নিত করার পর মোসাদ পরের ধাপের কাজগুলো শুরু করে। বিশেষ করে গুপ্তহত্যার পরিকল্পনা ও প্রক্রিয়াও তারা নির্ধারণ করে। যখন মোসাদের বিশেষজ্ঞ টিম প্রাথমিক অনুসন্ধান সম্পন্ন করে তারা তাদের সেই প্রতিবেদন সদর দফতরে পাঠিয়ে দেয়। মোসাদ প্রধান নিজেই সেই প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করেন এবং সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত দেন যদিও এই সব সিদ্ধান্তের কোন বৈধ বা আইনগত অনুমোদন থাকে না। শেষ পর্যন্ত ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নিজে অপারেশনটি পরিচালনার চুড়ান্ত ফায়সালা করেন।

মোসাদ যে শুধু ফিলিস্তিনি নেতাকর্মীকেই হত্যা করে তাই নয়। সংস্থার প্রয়োজনে তারা সিরিয়া, লেবানিজ, ইরানী এমনকি ইউরোপীয় নাগরিককেও হত্যা করতে দ্বিধা করে না।

১৯৭০ সাল থেকেই মোসাদ এ জাতীয় গুপ্ত হত্যা চালু শুরু করেছে। ১৯৭২ সালের ৮ জুন, ফিলিস্তিনের তৎকালীন সময়ের প্রধানতম লেখক এবং মুক্তিকামী আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র ঘাসসান কানাফানিকে হত্যা করা হয়। তিনি ছিলেন লেবাননের রাজধানী বৈরুতে। মোসাদের আততায়ীরা আগে থেকেই তার গাড়িতে বোমা পেতে রেখেছিল। পরে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। প্যালেস্টিনিয়ান লিবারেশন অর্গানেইজেশন, পিএলও’র ফ্রান্স শাখা প্রধান মাহমুদ হামসারিকে প্যারিসে এক গাড়ি বোমা হামলায় হত্যা করা হয় ১৯৭২ সালের ৮ ডিসেম্বর।

১৯৭৩ সালের ১০ এপ্রিল লেবাননের রাজধানী বৈরুতে প্যালেস্টাইনিয়ান লিবারেশন অরগানাইজেশনের (পিএলও) তিন শীর্ষ নেতা কামাল আদওয়ান, কামাল নাসের এবং মুহাম্মাদ ইউসেফ আল নাজ্জারকে হত্যা করে ছদ্মবেশী মোসাদ গোয়েন্দারা। পরবর্তীকালের ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাক নারীর সাজে ওই মিশনে অংশ নেন। এরপর থেকে ফিলিস্তিনের অনেক শীর্ষ নেতাকে হত্যা করে মোসাদ। একই সঙ্গে চলতে থাকে ইসরায়েলের অন্যান্য ‘শত্রু’ হত্যার মিশনও।

একই বছরের জানুয়ারীর ১০ তারিখে মোসাদের এক গাড়ি বোমা হামলায় ফিলিস্তিনের ফাতাহ আন্দোলনের সাইপ্রাস শাখা প্রধান হোসেইন আল বাশির নিহত হন। আক্রমনটি চালানো হয় সাইপ্রাসের নিকোশিয়ায়। ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে নরওয়েতে ফিলিস্তিনি নেতা আলী হাসান সালামেহ মনে করে একজন সাধারণ মানুষকে হত্যা করে মোসাদ। শেষ পর্যন্ত মোসাদ সফলভাবেই আলী হাসান সালামেহকে হত্যা করতে পারে ১৯৭৯ এর ২২ জানুয়ারী। আবারও সেই বৈরুতেই।

ফিলিস্তিনি নেতা খলিল ইব্রাহিম আল-ওয়াজির ওরফে আবু জিহাদকে হত্যার কথাও স্বীকার করেছিল ইহুদিবাদী ইসরাইল। ১৯৮৮ সালের ১৬ এপ্রিল তিউনিসিয়ার তিউনিসে তাকে হত্যা করা হয়। ১৯৯২ সালের ৮ জুন মোসাদ প্যারিসে অবস্থানরত প্যালেস্টাইন লিবারেশান অর্গানাইজেশান বা পিএলও’র নিরাপত্তা বিষয়ক কর্মকর্তা আতেফ বাসিসুকে হত্যা করে ছিলেন। ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা এই সন্ত্রাসী হত্যাকান্ড চালালেও বিশ্বজনমতের নিন্দার ভয়ে এর দায়দায়িত্ব স্বীকার করেনি। কিন্তু ১৯৯৯ সালের মার্চ মাসে ফ্রান্সের পুলিশ বিভিন্ন সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে জানায় যে, ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদই ফিলিস্তিনী কর্মকর্তা আতেফ বাসিসুকে হত্যার পরিকল্পনা নেয় ও তা বাস্তবায়ন করে।

১৯৯৫ সালের ২৬ অক্টোবর ফিলিস্তিনের ইসলামিক জিহাদ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ফাতহি শিকাকিকে হত্যা করে মোসাদ। জানা যায়, শিকাকি একটি গোপন সফরে লিবিয়ায় গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফেরার পথে তাকে মাল্টার একটি স্থানে হত্যা করা হয়। মাহমুদ আল মাবোও ছিলেন ফিলিস্তিনের আল কাসিম ব্রিগেডের অন্যতম সহপ্রতিষ্ঠাতা। ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারী দুবাইয়ের একটি হোটেলে আততায়ীরা তাকে হত্যা করে।

বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়াস্থ ফিলিস্তিন দুতাবাসে ২০১৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী ফিলিস্তিনের ‘পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অফ প্যালেস্টাইন’ এর নেতা ওমর নায়েফ জায়েদেকে আততায়ীরা হত্যা করে। তিনি ছিলেন ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামের আজীবন সংগ্রামী।

২০১৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিস থেকে ২৭০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বের ছোট্ট শহর ফাক্সে নিজের বাসার সামনে গুলি করে হত্যা করা হয় মোহাম্মদ আল-জাওয়ারিকে। ফাক্সের সবাই তাকে চিনতেন এভিয়েশন এক্সপার্ট মুরাদ নামে; এমনকি তার স্ত্রীও জানতেন না যে তার নাম মুরাদ না। হামাস তার মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করে জানায়- জাওয়ারি ছিলেন হামাসের মিলিটারি উইং কাসসাম ব্রিগেডের ড্রোন প্রোগ্রামের প্রধান।

২০১৮ সালের ২১ সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালুমপুরের জনবহুল রাস্তায় ৩৫ বছরের ফিলিস্তিনি প্রকৌশলী ফাতিহ আল বাতসকে হত্যা করা হয়। ফাতিহ তার জন্মভুমি গাজাতেই ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়াশোনা করেছেন এবং একই বিষয়ের উপর পিএইচডি করার জন্য তিনি মালয়েশিয়ায় গমন করেছিলেন। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী আন্দোলন হামাস প্রকৌশলী ফাতিহকে নিজেদের সক্রিয় কর্মী হিসেবে দাবী করে এই হত্যাকান্ডের জন্য মোসাদকে দায়ী করেছিল।

লেখক: কলাম লেখক

আরও পড়ুন