Ads

বিংশ শতাব্দীর সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্রঃ সাইকস-পিকট চুক্তি

নোমান বিন নজরুল

আপনাদের মধ্যে অনেকেই আমার মত জন্মের পর থেকে ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংঘাতের কথা শুনে আসছেন। কখনো হয়ত আরব ইসরাইল যুদ্ধ, আবার কখনো উপসাগরীয় যুদ্ধের ইতিহাস পড়ে অনেকেই শিহরিত হয়ে থাকেন। গত একশ বছরেরও বেশী সময় ধরে মধ্যপ্রাচ্যে চলা অসংখ্য সংঘাতের মূলে ছিল একটি “শতাব্দীর নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তি” যা সাইকস-পিকট চুক্তি নামে পরিচিত। আজকে আমরা সেই ইতিহাস নতুন ভাবে জানার চেষ্টা করবো।
১৯১৫ সাল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের উত্তপ্ত আবহাওয়ায় পৃথিবীবাসী প্রায় নাস্তানাবুদ। যুদ্ধে একদিকে রয়েছে Allied Powers (ফ্রান্স, ব্রিটেন, ইতালি,যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা,অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া) অন্যদিকে রয়েছে Central Powers(জার্মানি, অটোমান সাম্রাজ্য,অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া)। Allied Powers এর দুই মোড়ল রাষ্ট্র, ব্রিটেন আর ফ্রান্স তাদের প্রতিপক্ষের প্রতিরোধের ধার বিশ্লেষণ করে বুঝতে পেরেছে যে, Central Powers অচিরেই যুদ্ধে হেরে যাবে। সুতরাং যুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের যেসব এলাকা জয় করা হবে সেগুলোর বাটোয়ারা নিয়ে যুদ্ধ শেষে নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি এড়াতে ব্রিটেন এবং ফ্রান্স একটি গোপন ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়।

১৯১৫ সালের নভেম্বর মাস, ব্রিটেনের কূটনৈতিক মার্ক সাইকস (Mark Sykes) এবং ফ্রান্সের কূটনৈতিক জর্জ পিকট ( Georges picot) মিলিত হন এবং অটোমান সাম্রাজ্যের মধ্যপ্রাচ্যের অংশ ভাগবাটোয়ারা করার ক্ষেত্রে ঐক্যমতে পৌঁছাতে চেষ্টা করেন। তাদের আলোচনা চলে ১৯১৬ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত। অবশেষে, ১৯১৬ সালের মে মাসে তারা একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছান এবং ব্রিটেন ও ফ্রান্স রাষ্ট্রদ্বয়ের প্রতিনিধি হিসেবে তারা একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হন যা ইতিহাসে সাইকস-পিকট চুক্তি নামে পরিচিত (অফিসিয়ালি, এশিয়া মাইনর চুক্তি)।

চুক্তিতে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, আজকের ইরাক, কুয়েত, জর্দান থাকবে ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে এবং সিরিয়া, লেবানন ও দক্ষিন তুরস্ক থাকবে ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণে। এই ভাগবাটোয়ারায় রাশিয়ারও একটি অংশ ছিল। রাশিয়ার ভাগে আসে Turkish Strait, আর্মেনিয়া এবং ইস্তাম্বুল। ফ্রান্স আর ব্রিটেনের ভাগবাটোয়ারায় রাশিয়ার সম্রাটের সম্মতি থাকলেও ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় ঘটা বিপ্লবের মধ্যদিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া বলশেভিক নেতারা এতে সন্তুষ্ট ছিলেননা, ফলে সেসময়ের শাসক লেলিন তা অগ্রাহ্য করেন এবং এই ষড়যন্ত্রের কথা প্রকাশ করে দেন(১৯১৭)। ব্যাস, ষড়যন্ত্র প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথেই Allied Powers এর আরেক শক্তিশালী রাষ্ট্র “ইতালি” তার ভাগ বুঝে পাওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করে। বাধ্য হয়ে ইতালিকে তুরস্কের দক্ষিন ভূমধ্যসাগরের উপকূলীয় অংশ দিয়ে দেয়া হয়।

পাঠক, আপনাদের আবারো মনে করিয়ে দিতে চাই, এই ভাগবাটোয়ারা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই হচ্ছে এটা মাথায় রাখবেন।
ফিলিস্তিনের বিষয়ে তাদের আরেকটি গোপন সমঝোতা হয় যার আওতায় ফিলিস্তিনের দায়দায়িত্ব ব্রিটেনের হাতে ন্যস্ত করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে চুক্তি অনুযায়ী Allied Powers এর মোড়ল রাষ্ট্রসমূহ তাদের অংশ বুঝে নেয় আর এর মধ্যে দিয়েই অসংখ্য রক্তক্ষয়ী ইতিহাসের দ্বার খুলে যায়।

১৯১৬ সালের মে মাসে চুক্তিটি সম্পাদিত হওয়ার একমাস পর ঘটে আরেক ঘটনা। হেজাজের (বর্তমান সৌদি আরব) শাসক হুসেইন বিন আলী অটোমান সাম্রাজ্য থেকে আলাদা হয়ে অখন্ড আরব রাষ্ট্র গঠনের জন্য অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং এক্ষেত্রে তিনি ব্রিটিশদের সহযোগীতা চান।

মজার ব্যাপার হলো, হুসেইন বিন আলীর এমন এক সময় অখন্ড আরবের স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশদের সাহায্য চেয়েছিলেন যার এক মাস আগে আরব এলাকা ভাগাভাগি হয়ে গিয়েছিল কিন্তু সেটা তখনো প্রকাশ পায়নি। হুসেইন বিন আলীর এমন আমন্ত্রণ ব্রিটেন এবং ফ্রান্স লুফে নেয়, তারা অটোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহযোগীতা করার স্বার্থে আরবদের সিরিয়া দিয়ে দেয়ার অঙ্গীকার করে। আরবরাও সিরিয়া সমেত বিশাল আরব রাষ্ট্রের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ব্রিটেন-ফ্রান্সকে সহযোগীতা করে।

ব্রিটেন-ফ্রান্স-আরব মিলে হেজাজ রেলপথ ধ্বংস, আকাবা বন্দর দখল সহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যে অটোমানদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সৌদি আরব নিজের স্বাধীনতা অর্জন করতে পারলেও ব্রিটেন-ফ্রান্সের কাছ থেকে সিরিয়াকে আদায় করে নিতে পারেনি বরং সিরিয়া চলে যায় সাইকস-পিকট চুক্তি অনুযায়ী ফ্রান্সের পকেটে।

১৯১৬ সালে হওয়া গোপন সমঝোতা অনুযায়ী ফিলিস্তিনের ব্যাপারে কর্তৃত্ব চলে আসে ব্রিটেনের কাছে।১৯১৭ সালে তৎকালিন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ. জে. বেলফোর, ব্রিটিশ জায়নিস্ট ফেডারেশনের সভাপতি লর্ড রথসচাইল্ডকে একটি চিঠি লিখেন যেখানে তিনি “ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য স্থায়ী আবাসভূমির ব্যবস্থা করা হবে” এই মর্মে অঙ্গীকার করেন, ইতিহাসে যা বেলফোর ঘোষণা ( Balfour Declaration, 1917) নামে পরিচিত।বেলফোর ঘোষণার পর ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র গঠন হবে এই মর্মে ইঙ্গিত পেয়ে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে অসংখ্য ইহুদি ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে আর সেই সাথে শুরু হয় নতুন এক সংঘাতের।

১৯১৬ সালে হওয়া গোপন সমঝোতার উপর ভিত্তি করে ১৯২২ সালে লীগ অব নেশনস কর্তৃক ব্রিটেনকে অফিসিয়ালি ফিলিস্তিনের উপরে কর্তৃত্ব দেয়া হয় যা ব্রিটিশ ম্যান্ডেট হিসেবে পরিচিত। ১৯২৩ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটেন ফিলিস্তিনের অঞ্চলটি শাসন করে এবং ১৯৪৮ সালে ব্রিটেন মধ্যপ্রাচ্য থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়ার সময় তৈরী করে যায় ইসরাইল নামক এক বিষফোঁড়া। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হওয়া মাত্রই জর্ডান,মিশর, সিরিয়া, ইরাক,লেবাননের সাথে বেঁধে যায় তুমুল যুদ্ধ। সেই যে শুরু হয়েছে যুদ্ধের দামামা তা আজ অবধি চলছে।
সাইকস-পিকট চুক্তি ও ফিলিস্তিন নিয়ে ব্রিটেন-ফ্রান্সের মধ্যে গোপন সমঝোতার কারণে সৃষ্ট ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংকট মধ্যপ্রাচ্যের সম্পূর্ণ সংকটের একটা অংশ মাত্র।অন্য অংশের সংঘাতের তালিকা মোটেই কম নয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে, সাইকস-পিকট চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটেন-ফ্রান্স-রাশিয়া-ইতালির পকেটে যেসব রাষ্ট্র যায় সেসব রাষ্ট্রের জনগণ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বছরের পর বছর সংগ্রাম করেছে।

★ফ্রান্স লেবানন শাসন করেছে ১৯২০ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত। এই সময়ে তারা লেবাননের রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আনে খৃস্টানদের। আপরদিকে লেবাননে সুন্নি মুসলিমরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। লেবাননের আরেক অংশ ছিল শিয়া মুসলিম অধ্যুষিত। ফ্রান্স লেবানন ছেড়ে গেলে একটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর খৃস্টান-সুন্নি-শিয়া জনগণ ক্ষমতা নিয়ে ভীষণ দ্বন্দে জড়িয়ে পরে যা ১৯৭৫ সালে গিয়ে গৃহযুদ্ধে রূপ নেয় এবং এই গৃহযুদ্ধ শেষ হয় ১৫ বছর পর ১৯৯০ সালে।

★সাইকস-পিকট চুক্তি অনুযায়ী ফ্রান্সের পকেটে যাওয়া আরেকটি রাষ্ট্র সিরিয়া। ১৯৪৬ সালের এপ্রিলে সিরিয়া থেকে ফ্রান্স নিজেদের প্রত্যাহার করে নিলে সিরিয়াতেও ক্ষমতা নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ তৈরী হয় (১৯৫০-১৯৬০)। ১৯৬৩ সালে একটি অভুথ্যানের মধ্যে দিয়ে অনেকটা বাম ঘেঁষা একটি দল ক্ষমতায় আসে যার প্রধান ছিলেন বাশার আল আসাদের পিতা হাফিজ আল আসাদ। তিনি তথাকথিত (বিতর্কিত) ৫ বার গণভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং তিনি তার বিরোধী দলকে বিপুল বিক্রমে উৎখাত করতে সচেষ্ট ছিলেন। সিরিয়ার হোমস শহরে এক রাতে হামলা চালিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলের দশ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করেছিলেন তিনি। শিয়া মুসলিম হওয়ার তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নিদের ক্ষমতা থেকে দূরে রেখেছিলেন এবং তার পুত্র বাশার আল আসাদও একই পথ অবলম্বন করায় সিরিয়ায় যে গৃহযুদ্ধের সূচনা ঘটে তা এখনো বিদ্যমান।

★ব্রিটেন মধ্যপ্রাচ্য থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিলে ব্রিটেনের শাসনাধীন অঞ্চল থেকে একে একে ইরাক, জর্দান, কুয়েত নামক রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। ব্রিটেন চলে যাওয়ার পর কুয়েত সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পরেও ইরাক কুয়েতকে নিজের অঞ্চল বলে দাবী করে এবং বারবার তা দখল করার জন্য হুমকিও দেয়। ১৯৮০-১৯৮৮ সালের সময়টাতে ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় ইরাক অর্থসংকটে পড়লে কুয়েত থেকে আর্থিক সাহায্য চায়। কুয়েতও এই মর্মে আর্থিক সাহায্য করে যে আর কখনো ইরাক কুয়েতকে নিজের অংশ বলে দাবী করতে পারবে না। ইরাক-ইরান যুদ্ধ শেষ হবার পর অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত রাষ্ট্র ইরাক তেলসমৃদ্ধ কুয়েত দখল করে (১৯৯০, ২ আগস্ট) যার মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ। পরে আরেকটি উপসাগরীয় যুদ্ধের মাধ্যমে সাদ্দাম হোসাইন এর চুড়ান্ত পতন ঘটে এবং ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাকে হত্যা করা হয়।

★উপসাগরীয় সংকটের কারণেই আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় প্রতিটি দেশে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে অনুপ্রবেশ করে ঘাঁটি স্থাপন করে যা মধ্যপ্রাচ্যের সামগ্রিক নিরাপত্তাকে চরম হুমকির মুখে নিপতিত করেছে।

২য় বিশ্বযুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যে যতগুলো সংকটের ডালপালা তৈরী হয়েছে তা নিয়ে গবেষণা করলে আপনি এর শিকড় দেখবেন সাইকস-পিকট চুক্তিতে। ওসমানি সাম্রাজ্যের পরাজয়ের পর আরব রাষ্ট্রেগুলোকে দখল করে সেখানে ব্রিটেন এবং ফ্রান্স, মুসলিম-খৃস্টান-ইহুদি-শিয়া-সুন্নি বিভেদের যে বীজ বপন করে এসেছে তা এখন অঙ্কুরিত হয়ে সুবিশাল বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে এবং সেই বিষবৃক্ষ গত সাত দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যের ময়দানকে এতটাই বিষাক্ত করে রেখেছে যে যার বিষক্রিয়ায় জীবন দিতে হয়েছে( এখনো হচ্ছে) লক্ষ লক্ষ মানুষকে। এজন্য অধিকাংশ আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক এবং গবেষকদের মতে সাইকস-পিকট চুক্তি ছিল গত শতাব্দীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট চুক্তি।

তথ্যসূত্রঃ

★Sykes–Picot agreement – text at UNISPAL
★বিশ্বরাজনীতির ১০০ বছর (দ্বিতীয় খন্ড)- তারেক শামসুর রেহমান
★ইরাক কুয়েত সংকট ও বাংলাদেশের কূটনীতি -প্রফেসর ড. মো. ফজলুল হক
★সাইকস-পিকট চুক্তি (নিবন্ধ,2016)- Md. Aluddin Vuian, 1st secretary, Bangladesh Embassy, Canada.

একই ধরণের অন্যান্য আর্টিকেল প্যালেস্টাইন সংকটঃ মিঠেকড়া আলাপ

ফিলিস্তিন বিবাদে আরব নেতৃত্ব, ইতিহাসের এক ঝলক

লেখকঃ কলাম লেখক ও ছাত্র, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন