।। সাবির হোসেন সিফাত ।।
আমরা কমবেশি সকলেই “বন্ধুত্ব ” শব্দের সাথে পরিচিত। “বন্ধুত্ব” এমন একটি বন্ধন, যাতে থাকে স্বার্থহীন ভালোবাসা। পৃথিবীর অন্যতম নিষ্পাপ সম্পর্কের একটি বন্ধুত্ব। একে অন্যের সুখে-খুশিতে লাফিয়ে ওঠার; একে অপরের দুঃখে পাশে দাঁড়ানোর; মন খুলে কথা বলার; হেসে গড়াগড়ি আর চূড়ান্ত পাগলামি করার একমাত্র আধার এ বন্ধুত্ব। “বন্ধুত্ব” মানে এমন শক্তি যাকে কেউ জীর্ণ করতে পারেনা; যে সম্পর্ক পৌঁছে দেয় এক সুখময় আধারে; যে দূর্গ নস্যাৎ করতে অক্ষম সকল পরাশক্তি, যার ভালোবাসার গভীরতা হিমালয় অপেক্ষা বড্ড; যা হয় সাহায্যের অনুপম দৃষ্টান্ত, যা হবে জীবন চলার পথে ভুল শুধরানো স্বচ্ছ আয়না; যাতে আটকা পড়লে চলা যায়, দুশ্চিন্তার ঘনঘটে অধ্যায় ফেলে; যেখানে আছে শুধু নিঃস্বার্থ একরাশ ভালোবাসা; যেথায় আছে ঝগড়া, নেই কোন বিচ্ছেদ; আছে অনেক অভিমান, নেই কোন বিভাজন।
জীবন চলার পথে প্রত্যেকের জীবনে বন্ধু নামের বিশ্বাসী ও মজবুত একটি সম্পর্ক অত্যাবশ্যক। কেননা, বন্ধুহীন জীবন লবণবিহীন তরকারীর মত।বন্ধুহীন জীবন নাবিকহীন জাহাজের মত। বন্ধুহীন জীবন অক্সিজেনবিহীন সত্ত্বার মত। বারিধিতে চলমান কোন নাবিকহীন জাহাজ যেমন কোন লক্ষে পৌঁছা সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি বন্ধুহীন জীবন কোন সাফল্যে পৌঁছা সম্ভব নয়।স্রোতস্বিনীতে চলমান কোন মাঝিবিহীন তরীর যেমন তটে পৌঁছা দুর্বোধ্য, তদ্রূপ বন্ধুবিহীন জীবন সাফল্যে নোঙ্গর করা দুর্লভ। বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন তো বলেই ফেলেছেন “আমাদের রহস্যময়তার পরীক্ষণে প্রাপ্য সবচেয়ে সৌন্দর্যময় জিনিস হলো বন্ধুত্ব আর শিল্প বিজ্ঞান”। তাছাড়া বন্ধুহীন একাকীত্ব জীবন জীবন্মৃত নামান্তর। বিশেষ করে সম্প্রতি ঘটে যাওযা কয়েকটি ঘটনা বার বার ভাবিয়ে তুলে ” একাকীত্বের খানাখন্দ”।
(১) ৫০এর উর্ধে এক করোনা রোগা সুইসাইড নোট লেখে মুগদা হাসপাতাল থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহনন করে। লিখে গেছেন তার বন্ধুবিহীন একাকীত্বের কথা।টাকা ছিল, পয়সা ছিল, সবি ছিল। ছিলনা শুধু সঙ্গ দেওয়ার মত বন্ধু।
(২)খ্যাতনামা নায়িকা, প্রাক্তন সংসদ সদস্য কবরী করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান।মৃত্যুর পূর্বে তিনি একটি সাক্ষাতকারে সকলকে জানিয়ে যান তার বন্ধুবিহীন একাকীত্বের কথা।
(৩)খ্যাতনামা কলামিস্ট প্রফেসর তারেক শামসুর রহমানের লাশ তার বাসা থেকে দরজা, তালা ভেঙ্গে বের করা হয়। কি না ছিল তার সবি ছিল। টাকা -পয়সা-বাড়ী-গাড়ীর তার কোন কমতি ছিলনা।
তিনটি ঘটনায় মর্মাহত ঘটনা। শুধুমাত্র তেষ্টা ছিল সঙ্গীর, ভাল বন্বুর। আরহ্যাঁ, আগেই বলে রাখা ভাল,যে কেউ বন্ধু হতে পারে।ভাই-বোন, বাবা-মা, ক্লাস-মেন্ট, স্বামী বলা স্ত্রী।
সম্প্রতি বিবিসি বিশ্বের সবচেয়ে বড় গবেষণা চালিয়েছে “বন্ধুবিহীন একাকীত্বের” উপর।তাতে ৯ টি একাকীত্ব কাটিয়ে উঠার উপায় বের করেছে। তারমধ্য্য অন্যতম হল বন্ধুর সংস্পর্শে থাকা। আর এ একাকী জীবন হার্ট, স্নায়ূ, যৌনরোগ, ইত্যাদি ক্ষতিতে নিপতিত করে তোলে।
তাছাড়া আদিকালে লক্ষ করলে একই হিসাব কষতে হয়, আদম আ: এর একাকী ভালো না লাগায় আল্লাহ তায়ালা হাওয়া আ:কে তাঁর বন্ধু করে দিলেন।
[ কসাসুল কুরআনঃ ১ম খন্ড, ২৫ পৃষ্ঠা ; ইবনে জারীর আত-তাবারী (রহঃ)এর গ্রন্থ থেকে ইশতিয়াক মাহমুদ বর্ণনা করেছেন]
আর হ্যাঁ,
বন্ধু নির্বাচনে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ,
জীবন চলার পথে বন্ধুত্বের বাজারে দু’ধরনের লোক এসে পাড়ি জমাবে।একজন হবে ক্যারেক্টার গঠনে সফলতার চাবি কাঠি ও দৈবদুর্বিপাকে সহায়ক। আরেকজন হবে চরিত্র হননের হাতিয়ার ও সুসময়ের সহায়ক। মোদ্দাকথা, সৎ বন্ধু ও অসৎ বন্ধু। সৎ বন্ধুর কাছে তুমি পাবে গগনচুম্বী একরাশ নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। অসৎ বন্বুর কাছে পাবে সস্বার্থের কিছু ঘুলাটে ভালোবাসা। সৎ বন্ধু হবে তোমার জীবনে সফলতার হাতছানি; আর অসৎ বন্ধু তোমাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিবে।স্যার আবুল কালাম আজাদ বলেন- একটি বই একশোটি বন্ধুর সমান।আর একটি সৎ বন্ধু পুরো একটি লাইব্রেরীর সমান।বিজ্ঞানী নিৎসের উক্তিটি বেশ চমৎকার- বিশ্বস্ত বন্ধু হল প্রাণরক্ষাকারী ছায়ার মত।যে তা খুঁজে পেলো সে একটি গুপ্তধন খুুঁজে পেলো।
কিন্তু নাবী সা: থেকে পাওয়া সৎ ও অসৎ বন্ধুর ডিবেটের ফিরিস্তিটা আমার হৃদকোণে ব্যাপক দাগ এটেছে। নবিজি সা:বলেন:- সৎ ও অসৎ বন্ধুর উদাহরণ আতর বিক্রেতা ও কামারের ন্যায়। আতর বিক্রেতা হয়তো তোমাকে একটি আতর লাগিয়ে দিবে; নতুবা তুমি আতর ক্রয় করবে; নচেৎ অন্তত তার কাছ থেকে আতরের ঘ্রাণ পাবে। আর কামার হয়তো তোমার দেহ বা কাপড় পুড়িয়ে দিবে ; নতুবা তার কাছ থেকে খারাপ ঘ্রাণ পাবে।
(বুখারী :২১০১, মুসলিম: ২৬২৮)
এখন কাজ হল আতর বিক্রেতা ও কামারকে অর্থাৎ সৎ বন্ধু ও অসৎ বন্ধুকে স্টার মার্ক করা। প্রতিটি মানুষই এ সেক্টরে এসে দৈবদুর্বিপাকে পড়ে যায়। অন্তচক্ষু খোলে সামনের দিকে এগুতে পারেনা বন্ধুত্বের বাজারে। সত্যিই তো, এ জগতে সবকিছু চেনা গেলেও মানুষকে চেনা দুর্জ্ঞেয়। একজন সৎ; কালের ঘুর্ণাবর্তে হয়ে উঠে ভিজেবিড়াল। বিশ্বাসী একজন মানুষ কালের চক্রে হয়ে যায বকধার্মিক। তবুও হতাশ হওয়ার কোন হেতু নেই। দরদি মালি বরিত ইমামগণ সৎ ও অসৎ বন্ধুর বৈশিষ্ট্যগুলো আঙ্গুল দেখিয়ে দেখিয়ে লোচনে ধরিয়ে দিয়ে গেছেন।
ইমাম জাফর আস-সাদিক রহ: বলেন:- পাঁচ ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্ব করা ঠিক নয়।তারা হল, মিথ্যাবাদী, নির্বোধ, ভীরু, পাপাচারী ও কৃপণ ব্যক্তি।
কিংবদন্তী ইমাম গাঁজালি রহ: বলেন:- যার সথে বন্ধুত্ব করবে তার পাঁচটি গুণ থাকা চাই। বুদ্ধিমত্তা, সৎ স্বভাবের অধিকারী, পাপাচারী না হওয়া, বিদআতি না হওয়া, দুনিয়া আসক্ত না হওয়া।
কারো সাথে বন্ধুত্ব করার সময় তোমাকে সর্বদা হৃদে রাখতে হবে ইরানের বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক আল্লামা শেখ সাদীর জনপ্রিয় উক্তি “সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ”। তোমাকে সেই প্রবাদটি ভুললে চলবেনা ” সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে”। এগুলো স্বরণে রেখে বন্ধুত্বের নদীতে ডুব দিলে হয়তোবা সৎ বন্ধু না পাওয়ার যন্ত্রণায় কাতরাতে হবেনা। আরো স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, একজন দ্বীনদার বন্ধুই পারে কলুষিত জীবনকে ম্রিয়মাণ করতে। তাই, বন্ধু সার্কেলে তোমার দ্বীনদার বন্ধুই বেছে নেয়া উচিৎ।
কোথায় যেন পড়েছিলাম ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) এর দারুণ একটি উক্তি। তিনি বলেনঃ দ্বীনদার বন্ধুর সঙ্গে মিশলে তোমার ৬ টি উপকার হবে-
১. তাঁর সঙ্গ তোমার ভেতর থাকা দ্বীন নিয়ে সন্দেহ দূর করে, তোমার ঈমানকে আরো মজবুত করবে।
২.তাঁর সঙ্গ তোমার ভেতরে লুকিয়ে থাকা রিয়া দূর করে, তাকওয়া বাড়িয়ে দিবে।
৩.তাঁর সঙ্গ পেলেই তোমার ভেতরে আল্লাহর স্বরণ জাগ্রত হবে।
৪.তাঁর সঙ্গ তোমার ভেতরে অবস্থিত দুনিয়া আসক্তি কমিয়ে, আখিরাত মুখী করবে।
৫.তাঁর সঙ্গে মিশলে তুমি উদ্ধ্যত না হয়ে, বরং অধিক কোমল আর বিনয়ী হবে।
৬.তাঁর সঙ্গ তোমাকে মন্দ ধারণা থেকে বাচিয়ে রেখে, সুধারণার দিকে ধাবিত করবে।
প্রিয় পাঠক! আসলে জীবন হল অচিন দেশের সফর। আর অজানা পথের সফরে বিভিন্ন নদী-উপত্যকা, মরু-পর্বত, সমুদ্র-জঙ্গল পাড়ি দিয়ে ফিরে যেতে হবে আপন দেশ বেহেশতে। যে সফর একদিনের নয়, এক মাসের নয়, নয় এক বা কয়েক বছরের। কত সমস্যা, বাধা-বিঘ্ন এসে পাড়ি জমায় এ লম্বা সফরের দ্বারপ্রান্তে। সুতরাং এ সফরের জন্য যেমনি গাইড-বুক ও মানচিত্র চাই; তেমনি মনের মতো একজন সহায়ক চাই। আর একজন মুসলিম মুসাফিরের গাইডবুক আল-কুরআন, মানচিত্র হলো নবী(সাঃ)এর আদর্শ, আর সহায়ক হলো দ্বীনদার সৎ বন্ধু। তাছাড়া মজার ব্যাপার হলোঃ দ্বীনদার বন্ধু গ্রহণ করলে, হাশরের দিন বড্ড প্রাইজ রয়েছে-
” হাশরের দিনে ৭ শ্রেণির লোকদের বিশেষ ছায়াতলে আশ্রয় দেয়া হবে, তন্মধ্যে অন্যতম দ্বীনদার বন্ধু গ্রহণ করার করণে” [সহীহ্ বুখারী660, সহীহ মুসলিমঃ 1032]
লেখকঃ প্রবন্ধ লেখক
আরও পড়ুন-
জোরুজালেমে রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে হযরত ওমর (রা:) এর অনুভূতি