Ads

সন্দেহ যেভাবে অশান্তির কারণ

অধ্যাপিকা মৌলুদা খাতুন মলি
এক.
ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি যে- কাউকে ‘সন্দেহ’ করা নাকি একপ্রকার রোগ। ভয়ঙ্কর রোগ। যা ক্যান্সারের চেয়েও মারাত্মক।
এতদিন বাদে আজ মনে হচ্ছে যে- হ্যা, কথাটি একদমই সত্যি।
খেয়াল করে দেখবেন- এই সন্দেহ বাতিক মানুষগুলো কিন্তু জীবনে সুখি হয় খুব কমই। সারাটা জীবন শুধু এরা একে অপরকে সন্দেহ করেই কাটিয়ে দেয়। ‘সুখ’ নামক হরিনটা ধরা দিতে চাইলেও…সন্দেহবশত এরা তা নিতে জানে না। অহেতুক সন্দেহের কারণে অনেক সুখের সংসার ভেংগেও গেছে। এ ভয়ংকর রোগটি আবার তুলনামূলক মেয়েদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়। অন্তত আমার জানামতে। (অবশ্য- কিছু ব্যতিক্রম তো আছেই)।
গত দু/তিনদিন ধরে আমাকে টানা কলেজ যেতে হচ্ছে। ছাত্রীদের অ্যাসাইনমেন্ট জমা নেয়ার জন্য। করোনাকালীন সময়ে অনেকদিন পর পর কলেজ যাই। ফলে কলেজ যাবার কথা হলেই- একটু আলাদারকম ফিল আসে। মনের মাঝে এক অন্যরকম ভাললাগার আবেগ কাজ করে। কলেজ যাবার আগে- আমি আবার দু/চারজন প্রিয়মুখকে ফোন দিয়ে ডেকে নিয়ে যাই। একসাথে সময়টাকে দারুণ উপভোগ্য করার জন্য। দীর্ঘ ২৬/২৭ বছর ধরে একসাথে চাকরি করছি। যার ফলে- আলহামদুলিল্লাহ্‌, সবার সাথেই একটা গভীর সু-সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। তাছাড়া আমাদের কলেজপাগল এবং মানুষপাগল শ্রদ্ধেয় প্রিন্সিপ্যাল স্যারতো কাউকে পেলেই ব্যস, হয়েছে! আর সহজে উঠা মুশকিল। উনার শ্রদ্ধা-স্নেহমমতায় মুগ্ধ হয়ে- থাকতেই হয় অনেকক্ষণ। স্যারের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা এবং শুভকামনা নিরন্তর।
গতকাল কলেজ থেকে বাসায় ফিরলাম- পৌনে তিনটার দিকে। দেখি- সাহেব ছেলেমেয়েদের সাথে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে অপেক্ষা করছেন- একসাথে লাঞ্চ করার জন্য। আমাদের পরিবারে এটা একটা ট্র্যাডিশন বলা যেতে পারে। আমরা সাধারণত বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে অলওয়েজ একসাথেই খাই। সচরাচর ব্যতিক্রম হয়। খাবার পর একটু গল্পগুজব, আলাপ-আলোচনা তো হয়ই। প্রতিটা দিন, প্রতিটা বেলায়-ই। যাহোক- জিভ কেটে আমি শুধু ‘সরি’ বলে তাড়াহুড়ো করে ওয়াশ রুমে ঢুকতে যাবো– হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। আবার ব্যাক গিয়ার দিলাম।
দেখি সাগরিকা’র ফোন।
আমার চাকরি জীবনের প্রথম দিককার ছাত্রী সে।
দুই.
সন্ধ্যায় সাগরিকা বাসায় এলো।
শিশু-কিশোরী ফুটফুটে তিন রাজকন্যাকে সাথে নিয়ে। একটা ছেলে সন্তানের আশায়- এখন তিন কন্যা সন্তানের মা সে। চেহারাপাতি আগের মত অতি লাবণ্যময় না থাকলেও এখনো যথেষ্ট স্মার্ট সে! ঢাকার কোনো এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে এডমিনে আছে। স্বামী ব্যাংকার। যদিও উভয়ের পছন্দেই বিয়েটা হয়েছিল- কিন্তু আর বনিবনা না হওয়ায় দশ মাস হলো- ওরা আলাদা বাসায় থাকছে। এখন ডিভোর্সের প্রস্তুতি চলছে…
আজ কি ভেবে সে আমার কাছে পরামর্শের জন্য এসেছে।
সাগরিকার মুখে ওদের দাম্পত্যকলহের ডিটেইলস শুনলাম।
তার সার সংক্ষেপ এইরকম-
★ রাসেল (সাগরিকা’র স্বামী) অফিসিয়াল কাজের ব্যস্ততা দেখিয়ে রোজ রাত করে বাসায় ফেরে। ফোনেও ব্যস্ততা দেখায়।
সাগরিকা তা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। স্বামীকে সন্দেহ করে। ব্যাংক আওয়ার জানে সে। সাগরিকার যুক্তি হলো- হঠাৎ মটাৎ রাত হতে পারে- কিন্তু রোজরোজ দেরি হতে পারে না। অকাট্য যুক্তি তার!
★ সাপ্তাহিক ছুটিতেও মেয়েদের নিয়ে কোথাও বেড়াতে যায় না রাসেল। ছেলে সন্তান নেই জন্য- হয়ত মেয়েদের প্রতি ওর স্নেহ-ভালবাসা একদমই নেই।
★ ‘অডিট আছে’ বলে প্রতি মাসে রাসেল ঢাকার বাইরে যায়। এটি সাগরিকার কাছে মহা সন্দেহজনক। নিশ্চয়ই ‘ছেলে’র আশায় চুপ করে আরেকটা বিয়ে করেছে রাসেল। এবং করেছেই-ই। হয়ত গ্রামের কোনো গরিব, কমবয়সী কুমারী মেয়েকে অনেক টাকার বিনিময়ে…। হর-হামেশা এসব হচ্ছেতো! আজকাল ছেলেদের কোনো বিশ্বাসই নেই।
★ স্বামীর দরিদ্রতা মেনে নেয়া যায় কিন্তু লাম্পট্য কক্ষনো মেনে নেয়া যায় না। মহা সত্যকথা এটি!
★ সাগরিকার আরেকটি অভিযোগ হলো-
স্ত্রী বেঁচে থাকাকালীন স্বামীর ভাগ অন্য কাউকে দেয়া যায় না। ইম্পসিবল!! প্রয়োজনে ছাড়াছাড়ি হতে পারে।
★ ইসলামে একাধিক বিয়ে যতই হালাল আর জায়েজ থাকুক- তারপরও বাঙালি মেয়েরা এখনো অতটা উদার হতে পারেনি যে, স্বামী আরেকটা মেয়ের সাথে মিশবে- আর জেনেশুনে বউরা তা সহজভাবে মেনে নেবে। উঁহু অসম্ভব, এটি মেনে নেয়া অত্যন্ত কঠিনতর ব্যাপার!(যদিওবা কাউকে তা নিতে হয়-হচ্ছে)।
রাসেলের বিরুদ্ধে এইরকম হাজারো অভিযোগ শুনলাম সাগরিকার মুখে।
কথা বলতে বলতে একসময় সাগরিকা অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করলো। হঠাৎ ওর তিন বছরের ছোট মেয়েটাকে কষে থাপ্পড় মারলো। মেজটার চুলের ঝুটি ধরে টান মারলো। বড় মেয়েটা বেশ চালাকচতুর। সে ভাব বুঝে তরিৎবেগে আমার কাছে চলে এলো। তিনজনেই লজ্জায়, ভয়ে কাঁপছে। চোখ বেয়ে ফোটা ফোটা পানি পড়ছে নিঃশব্দে।
সাগরিকা তখনো রাগে ফুঁসছে!
আমি অবাক হয়ে ওর আচরণ দেখছি।
একটুপর আমার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে সে বললো-
— ম্যাডাম, সরি। আমি পাগল হয়ে গেছি ম্যাডাম, সত্যিই পাগল হয়ে গেছি। রাসেল আমাকে পাগল বানিয়ে ছেড়েছে। মেয়েরা হয়েছে আরেক মহাজ্বালা, অশান্তির মূল। এই তিন ‘যম’ যদি না থাকতো- আমি রাসেলকে আরও অনেক আগে ‘তালাক’ দিয়ে ফ্রি হয়ে চলে আসতাম!
আর কথা বলতে পারছে না বেচারি। কান্নায় ভেঙে পড়েছে।
বাবা-মা হারা এতিম সাগরিকাকে বুকের মাঝে টেনে নিলাম। এখন ওর পাশে থাকা খুব দরকার। ওকে অনেক বুঝাতে হবে। নইলে মেয়েটি সত্যিই পাগল হবে যে!! রাগের মাথায় হুটহাট ডিসিশন নিয়ে সংসার ভাঙা যাবে না। সংসার ভাঙা খুব সহজ- কিন্তু টিকে রাখা বড়ই কঠিন।
আমাদের সমাজব্যবস্থা এখনো মেয়েদের যথাযোগ্য সম্মান, আশ্রয় দিতে শেখেনি। ডিভোর্সি অথবা অভিভাবকহীন মেয়েদের সহজভাবে মেনে নেয়না এ সমাজ। তাদের নামে নানান বদনাম ছড়ায়। যোগ্য-অযোগ্য ভুলে যে সে বিয়ের প্রস্তাব, কুপ্রস্তাব দেয়। বিভিন্নভাবে উত্যক্ত করে। যাহোক।
নাম্বার নিয়ে একসময় রাসেলকে ফোন দিলাম।
পরিচয় দিয়ে অনেকক্ষণ কথা বললাম ওর সাথে। ওরে আল্লাহ! কথা বলে আমিতো রীতিমত কনফিউজড! হায় আল্লাহ্‌, কার অভিযোগ ধরে বিচার করি এখন? রাসেলের কথা শুনে মনে হলো-এযুগে ওর মতো এত ভাল-ভদ্র ছেলেই হয় না! পাঁচ ওয়াক্ত নামায সে জামায়াতে পড়ে। তাহাজ্জদ পড়ে। সময় বের করে সহিহ-শুদ্ধভাবে কুরআন পড়াও শিখছে। গ্রামে গরিবদের সাহায্য করায় তার জুড়ি নেই। মাদ্রাসা, দাতব্য চিকিৎসালয় আরও কত কি সে গাঁটের টাকা খরচ করে করছে। এত সামাজিক কাজের ফিরিস্তি শুনে রাসেলকে কি বলবো আমি- বুঝতে পারছি না। মহা ব্যস্ত সে!
একদিকে সাগরিকার কান্নাকাটি, অভিযোগ; অন্যদিকে রাসেলের সারল্যতা, পরহেজগারি, ব্যস্ততা, সাগরিকা আর মেয়েদের প্রতি গভীর ভালবাসার গল্প। উহ, কি কঠিন সমস্যা!! কাকে বিশ্বাস করবো আমি? রাসেল না সাগরিকাকে?আল্লাহ্‌ পাক আপনি সাহায্য করুন। ওদেরকে সঠিকভাবে দিকনির্দেশনা দেয়ার তাওফিক দিন। সব সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে- ওদের জীবন, সন্তান-সংসার বাঁচান, আমিন।
সন্দেহ অশান্তির কারণ- সন্দেহ অশান্তির কারণ – সন্দেহ অশান্তির কারণ – সন্দেহ অশান্তির কারণ
মলি, বগুড়া।
৩০ আগস্ট/২১
লেখকঃ সাহিত্যিক ও শিক্ষক
লেখকের আর লেখা পড়ুন-
আরও পড়ুন