Ads

জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে  

।। উম্মে হানী বিনতে আলী ।।

প্রায় দু-মাস পর জন্মভূমি সংলগ্ন কেন্দ্রীয় কবরস্থানে যাওয়া হয় এবার। এ যেন দু’মাস না বছর খানেক মনে হচ্ছিলো। কেননা সেখানে শায়িত আছেন আমার প্রাণাধিক প্রিয় বাবা,চাচা,বড়াব্বুরা,সেজো ফুপি,আর খুব আদুরে দু’জন মানুষ আমার দাদু,দাদী যাঁদের সাক্ষাৎ পাইনি এ ধরাধামে।আর নাম না জানা, সম্পর্কে না বাঁধা কতোশতো মানুষ কবরস্থ সেখানে।যাদের সাথে যোজন যোজন দূরত্ব আজ দুনিয়াবাসীর।

এই দীর্ঘ সময়ের ব্যপ্তিতে ঢের বুঝেছি বাবাকে ছেড়ে থাকা খুব কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যায় বাড়িতে।এখানে এলে যেন স্বস্তি পাইনা।বাবার সাথে কাটানো গভীর রজনীগুলো গল্পের থরে সাজানো ছিলো আমার জীবন। সেই আমি ভীষণ একেলা সেমূহুর্তে। আমাদের বাবা মেয়ের খুনসুটিগুলো যে চোখের পলকেই বিরতি নেবে যদি জানতাম তবে সেসময় বাবাকে ছেড়ে দূরে থাকতাম না। আবার বিদায়কালীন সময়ে বাবা যে আমার অপেক্ষাতেই ছিলেন কখন আসবে তার সেজো কন্যা। ইশশশ্ বাবা আজো আমার মনে দাগ কাটে ভীষণ আপনার সাথে কাটানো শেষ যাত্রাগুলো বাড়ি থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, আবার সেখান থেকে বগুড়া জিয়া মেডিকেল,তারপর বারডেম-ঢাকা মেডিকেল…….

ঢামেকের আইসিইউতে একটা সিট খুব নীড ছিলো বাবার জন্য। কোনোভাবেই ম্যানেজ হচ্ছিলো না । কতোজনকেই না বলেছিলাম। অতঃপর আমার ডিএ্যাকটিভ আইডিটা সচল করে সেদিন একটা পোস্ট দেয়ার আধাঘন্টা সময়ের ব্যপ্তিতেই আমি আল্লাহর দয়ায় এক ফার্মাসিস্ট আপুর সহযোগিতা পেয়েছিলাম। আল্লাহ্ ঐ আপুকে উভয় জগতে আগলে রাখুন, হেদায়েতের নূর ঢেলে দিন ওনার অন্তরে। আমীন।

আরও পড়ুন- আত্মার পরিশুদ্ধি

অতঃপর বাবাকে আইসিইউ তে নেয়া হলো রাত নয় ঘটিকায়! ডক্টর রা একের পর এক মেডিসিন ট্রাই করতে থাকেন কতোশতোবার মেডিসিন আনতে দেন ওনারা তা গণনায় নেই। আমি আর মেজো আপু মেডিসিন নীডেড জিনিসগুলো আনতে আনতে ক্লান্ত হয়েও ক্লান্ত হবার সুযোগ ছিলো না। মেজো আপু,ওনার জামাই বাবার ব্লাড টেস্ট রিপোর্ট এ মেডিকেল থেকে আরেক মেডিকেলে দৌড়ের ওপর ছিলো। আর আমার সময় তখন অতিবাহিত হচ্ছিলো আইসিইউ এর ভেতর-বাহির। প্রিয়জনরা,আবু আয়িশাহ্ তখন আমাকে নিয়ে চিন্তিত ছিলেন হঠাৎ নাজানি কখন আমিই অসুস্থ হয়ে যাই,হসপিটালাইজড হতে হয়….! যখনই বাবার কেবিন নম্বর বলে ডাক আসে আমি হন্তদন্ত হয়ে গাউন পরে প্রবেশ করি। বাবার কাছে যাই, বাবার হাতে হাত রেখে সূরা ইয়াসিন,রহমান,ফজরের কিছু অংশ তিলাওয়াত করে ছুঁয়ে দিলে বাবা ঠোঁটের কোণে হাসি দেখি,এতো কষ্ট যন্ত্রণা সহ্য করেছে, এতো অস্থিরতায় ঘেমে একাকার হয়েছে ওনার গা বেয়ে বেয়ে এসি থাকা স্বত্বেও, হাত পাখা দেখাতো ইশারায় আরো বাতাস দাও। আহারে জীবন! তবু যেন ওনার ঠোঁটে লেগেছিলো সবসময়ই ইস্তেগফার আর কালিমা! অথচ উনি কোনো কথাই বলতে পারছিলেন না। শুধু রব্বের কালাম ছাড়া! সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহ্। এ যেন কালামুল্লাহর মু’জেযা।

যখন রাত্রি শেষের পথে আপু যায় বাবার কাছে তখনি ও বুঝতে পারে বাবা এক্সপায়ার্ড করে যাচ্ছে হয়তো কিছু সময়ের মধ্যে আমাদের ছেড়ে এ দুনিয়া ছেড়ে। আপুও দু’আ পড়ে দিয়ে চলে এসেছে। আমাকে কিচ্ছু জানায়নি আপু এ পর্যায়ে এখন..! আপু যেন এসে ওয়েটিং রুমে কি ক্লান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছিলো। আর আমার সেরাত থেকেই সমস্ত ঘুম চলে গিয়েছে যেন। খুব অস্থিরতায় ভোর হয়ে গেলো। সকাল বাড়তে লাগলো এর মধ্যেই জানতে পারলাম আমাদের দু’আর প্রিয় একটা মানুষ আমাদের ছেড়ে আল্লাহর কাছে…..!

আরও পড়ুন- কোভিড-১৯ এ তিক্ত অভিজ্ঞতা

এইতো জীবন! বাবাকে আর বলা হলোনা বাবা জানলেন না তখন আমি মা হতে যাচ্ছি আপনি নানু হবেন আহা আমার বাবার মতো এতো সুন্দর ইলম আখলাকওয়ালা মানুষটাকে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম পেলেন না। কতোকিছু শেখার ছিলো আরো বাবার কাছে!

বাবা আমায় শিখিয়ে গেলেন কবরের জীবনটা কি আসলে। এখন আর কবরভীতি খুব আসে না, কবরস্থানে গেলে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করতে, কবরবাসীদের নিয়ে ভাবতেই যেন সুকুন লাগে অন্তরে। তবে এ অতিসামান্য আমল, ঈমানের এ হালত নিয়ে ভয় হয়। এমূহুর্তেই যদি এপার ছেড়ে যাবার ডাক আসে তখন কেমন হবে এই গুনাহগারের কবরের জীবন? পারবতো কবরের সওয়াল-জবাব ঠিকভাবে? রবের সন্তুষ্টি নিয়ে একটা সুন্দর মৃত্যু হবেতো? রেখে যেতে পারবতো সাদকায়ে জারিয়া?কি হবে, কে হবে আমার সাদকায়ে জারিয়া?সময়টুকুন পাবোতো মালিক? ফিরে এসো রব্বের দেখানো পথে যে পথ চলে গেছে জান্নাতে! রব্বির হাম হুমা কামা রব্বা ইয়ানী সগীর…. ভোর- তিনটা বেজে চল্লিশ মিনিট সাত.দশ.বাইশ

 

লেখকঃ গল্পকার ও কলাম লেখক 

 

ফেসবুকে লেখকে পেতে এই লিংকে ক্লিক করুন-Umme Honey Binte Ali

জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে   – জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে   – জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে

আরও পড়ুন