Ads

লাইলাতুল কদর ও আমাদের করণীয়  

।। ডঃ আব্দুল্লাহ আল মামুন আযহারী ।।

রমযান মাসে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ রজনী হলো লাইলাতুল কদর। এ রজনীর ফযিলত সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেন,

إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ (1) وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ (2) لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ (3) تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ (4) سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ (5)

“নিশ্চয় আমরা এটি (কুরআন) নাযিল করেছি ‘লাইলাতুল কদরে’। তোমাকে কিসে জানাবে ‘লাইলাতুল কদর’ কী? ‘লাইলাতুল কদর’ হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। সে রাতে ফিরিশতারা ও রূহ (জিবরীল) তাদের রবের অনুমতিক্রমে সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে অবতরণ করে। শান্তিময় সেই রাত, ফজরের সূচনা পর্যন্ত।” [সূরা আল-কাদর: ১-৫]

লাইলাতুল কদরের পরিচয় ও নামকরণ:

লাইলাহ ও কদর দু’টি শব্দের সমন্বয়ে লাইলাতুল কদর হয়েছে। লাইলাহ শব্দের অর্থ রাত। আর কদর শব্দের কয়েকটি অর্থ রয়েছে। সেগুলো হলো:

১ – কদরের এক অর্থ সম্মান। ইরশাদ হয়েছে :

(وَمَا قَدَرُوا اللَّهَ حَقَّ قَدْرِهِ)

{আর তারা আল্লাহকে যথার্থ সম্মান দেয়নি} [ সূরা আল আনআম:৯১]

সে হিসেবে লায়লাতুল কদর অর্থ হবে সম্মানিত রাত; কেননা এ রাতে কুরআন নাযিল হয়েছে, এ রাতে ফেরেশতাগণ নেমে আসেন এবং এ রাতে রবকত-রহমত-মাগফিরাত নাযিল হয়।

২ – কদরের আরেক অর্থ সংকীর্ণকরণ, যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন:

لِيُنْفِقْ ذُو سَعَةٍ مِنْ سَعَتِهِ وَمَنْ قُدِرَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ فَلْيُنْفِقْ مِمَّا آتَاهُ اللَّهُ

“সামর্থ্যবান যেন নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যয় করে আর যার রিযিক সংকীর্ণ করা হয়েছে সে যেন  আল্লাহ  তাকে যা দিয়েছেন তা হতে ব্যয় করে।” [ সূরা আত-তালাক:৭]

লায়লাতুল কদরের ক্ষেত্রে সংকীর্ণকরণের অর্থ হবে লায়লাতুল কদর সংঘটিত হওয়ার সুনির্দিষ্ট তারিখ গোপন করে রাখা।

৩ – কাদর শব্দটি কাদার (قَدَرَ) তথা তাকদীর থেকেও উৎকলিত হতে পারে, যার অর্থ হবে এ রাতে আল্লাহ তাআলা সে বছরের সকল আহকাম নির্ধারণ করেন।

– لأنه يُقَدَّر فيها ما يكون في تلك السَّنَة؛ قال تعالى: ﴿فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ﴾ [الدخان: 4].

আল্লাহ তাআলা বলেন:

(يُفۡرَقُ كُلُّ أَمۡرٍ حَكِيمٍ )

{সে রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়} [সূরা আদ-দুখান:৪]

 

এ তারিখটি নির্দিষ্ট করে কোন দিন তা কেউ শতভাগ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। এটি আল্লাহ বান্দার অধিক কল্যাণ লাভের সুযোগ সৃষ্টি করে অনেকটা অষ্পষ্ট রেখেছেন। তবে রমযানের সাতাশ তারিখ লাইলাতুল কদরের সর্বাধিক সম্ভাবনাময় রাত। সহীহ মুসলিমে উবাই ইবন কা’ব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি লাইলাতুল কদর সম্পর্কে বলেন,

وَوَاللهِ إِنِّي لَأَعْلَمُ أَيُّ لَيْلَةٍ هِيَ، هِيَ اللَّيْلَةُ الَّتِي أَمَرَنَا بِهَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِقِيَامِهَا، هِيَ لَيْلَةُ صَبِيحَةِ سَبْعٍ وَعِشْرِينَ، وَأَمَارَتُهَا أَنْ تَطْلُعَ الشَّمْسُ فِي صَبِيحَةِ يَوْمِهَا بَيْضَاءَ لَا شُعَاعَ لَهَا.

“আল্লাহর কসম আমি এ রাত (লাইলাতুল কদর) সম্পর্কে অধিক জানি। এটি সে রাত যে রাতে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে সালাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। আর এটি সাতাশ তারিখ রাত। আর ঐ রাতের আলামাত হল, সে রাত শেষে সকালে সূর্য উদিত হবে তা উজ্জ্বল হবে; কিন্তু সে সময় (উদয়ের সময়) তার কোন তীব্র আলোকরশ্মি থাকবে না (অর্থাৎ দিনের তুলনায় কিছুটা নিষ্প্রভ হবে)।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৬২)

ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত যে,

أَنَّ رِجَالًا مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، أُرُوا لَيْلَةَ القَدْرِ فِي المَنَامِ فِي السَّبْعِ الأَوَاخِرِ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَرَى رُؤْيَاكُمْ قَدْ تَوَاطَأَتْ فِي السَّبْعِ الأَوَاخِرِ، فَمَنْ كَانَ مُتَحَرِّيهَا فَلْيَتَحَرَّهَا فِي السَّبْعِ الأَوَاخِرِ»

“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কতিপয় সাহাবীকে স্বপ্নযোগে রমযানের শেষের সাত রাতে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়। (এ শোনে) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমাকেও তোমাদের স্বপ্নের অনুরূপ দেখানো হয়েছে। (তোমাদের দেখা ও আমার দেখা) শেষ সাত দিনের ক্ষেত্রে মিলে গেছে। অতএব, যে ব্যক্তি এর সন্ধান প্রত্যাশী, সে যেন শেষ সাত রাতে সন্ধান করে।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২০১৫, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৬৫।)

ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«الْتَمِسُوهَا فِي الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ – يَعْنِي لَيْلَةَ الْقَدْرِ – فَإِنْ ضَعُفَ أَحَدُكُمْ أَوْ عَجَزَ، فَلَا يُغْلَبَنَّ عَلَى السَّبْعِ الْبَوَاقِي»

“তোমরা রমযানের শেষ দশদিনে কদরের রাত অনুসন্ধান কর। তোমাদের কেউ যদি দুর্বল অথবা অপারগ হয়ে পরে, তবে সে যেন শেষ সাত রাতে অলসতা না করে”। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৬৫)

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ দশকের বেজোড় রাতে লাইলাতুল কদর তালাশ করতে আদেশ করেছেন। ইবন ‘আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«التَمِسُوهَا فِي العَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ لَيْلَةَ القَدْرِ، فِي تَاسِعَةٍ تَبْقَى، فِي سَابِعَةٍ تَبْقَى، فِي خَامِسَةٍ تَبْقَى»

“তোমরা তা (লাইলাতুল কদর) রমজানের শেষ দশকে তালাশ করো (শেষ দিক থেকে গনণায়) নবম, সপ্তম বা পঞ্চম রাত অবশিষ্ট থাকে”। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২০২১।)

বুখারীর অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«هِيَ فِي العَشْرِ الأَوَاخِرِ، هِيَ فِي تِسْعٍ يَمْضِينَ، أَوْ فِي سَبْعٍ يَبْقَيْنَ»

“তা শেষ দশকে, তা অতিবাহিত নবম রাতে অথবা অবশিষ্ট সপ্তম রাতে অর্থাৎ লাইলাতুল কদর।”( সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২০২২)

উয়াইনা ইবন আবদুর রহমান বলেন, আমার পিতা আবদুর রহমান রা. বলেন,

ذُكِرَتْ لَيْلَةُ القَدْرِ عِنْدَ أَبِي بَكْرَةَ فَقَالَ: مَا أَنَا مُلْتَمِسُهَا لِشَيْءٍ سَمِعْتُهُ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَّا فِي العَشْرِ الأَوَاخِرِ، فَإِنِّي سَمِعْتُهُ يَقُولُ: «التَمِسُوهَا فِي تِسْعٍ يَبْقَيْنَ، أَوْ فِي سَبْعٍ يَبْقَيْنَ، أَوْ فِي خَمْسٍ يَبْقَيْنَ، أَوْ فِي ثَلَاثِ أَوَاخِرِ لَيْلَةٍ» ، وَكَانَ أَبُو بَكْرَةَ يُصَلِّي فِي العِشْرِينَ مِنْ رَمَضَانَ كَصَلَاتِهِ فِي سَائِرِ السَّنَةِ، فَإِذَا دَخَلَ العَشْرُ اجْتَهَدَ

আবু বাকরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর কাছে একবার লাইলাতুল ক্বাদর সম্পর্কে আলোচনা হলো। তিনি বললেন, আমি লাইলাতুল ক্বাদর রামাযানের শেষ দশ দিন ছাড়া অন্য কোনো রাতে অনুসন্ধান করব না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে একটি বাণী শোনার কারণে তাকে বলতে শুনেছি যে, তোমরা এ রাতটিকে রমযানের নয় দিন বাকী থাকতে বা সাতদিন বাকী থাকতে বা পাঁচ দিন বাকী থাকতে বা তিন দিন বাকী থাকতে বা এর শেষ রাতে অণ্বেষণ কর। বর্ণনাকারী বলেন, আবু বাকরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রামাযানের বিশ দিন পর্যন্ত অন্যান্য সুন্নাতের মতোই সালাত আদায় করতেন। কিন্তু শেষ দশ দিনের ক্ষেত্রে খুবই প্রচেষ্টা চালাতেন।”(তিরমিযী, ৭৯৪, ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন, হাদীসটি হাসান সহীহ। ইবন হিব্বান, ৩৬৮৬, শু‘য়াইব আরনাঊত বলেছেন, হাদীসের সনদটি সহীহ। মুসতাদরাকে হাকিম, ১৫৯৮, ইমাম হাকিম রহ. বলেছেন, হাদীসটির সনদ সহীহ, তবে ইমাম বুখারী ও মুসলিম রহ. তাখরিজ করেননি)

عَنِ ابْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ أُنَيْسٍ الْجُهَنِيِّ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، إِنَّ لِي بَادِيَةً أَكُونُ فِيهَا، وَأَنَا أُصَلِّي فِيهَا بِحَمْدِ اللَّهِ، فَمُرْنِي بِلَيْلَةٍ أَنْزِلُهَا إِلَى هَذَا الْمَسْجِدِ، فَقَالَ: «انْزِلْ لَيْلَةَ ثَلَاثٍ وَعِشْرِينَ»

আব্দুল্লাহ ইবন উনাইস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি এক গ্রামে থাকি এবং সেখানে আলহামদুলিল্লাহ সালাত আদায় করি। অত:এব, আমাকে লাইলাতুল কদরে সংবাদ দিন সে রাতে এ মসজিদে এসে সালাত আদায় করব। তিনি বললেন, তুমি তেইশ তারিখ রাতে এসো।” (আবু দাউদ, হাদীস নং ১৩৮০, আলবানী রহ. হাদীসটিকে হাসান সহীহ বলেছেন)

কেউ কেউ চব্বিশ রমযান রাতে লাইলাতুল কদর তালাশ করে থাকেন। এটি আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ও হাসান রহ. এর মত। হাসান রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি সূর্যকে বিশ বছর যাবত পর্যবেক্ষণ করেছি। আর চব্বিশে রমযান সূর্য উদিত হয় কিন্তু এর আলোকরশ্মি থাকে না। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে অনুরূপ বর্ণনা আছে, ইমাম বুখারী তা উল্লেখ করেছেন; তবে তিনি বলেছেন, ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে সঠিক বর্ণনা হলো তেইশ তারিখ দিবাগত রাত। আইঊব সাখতিয়ানী রহ. তেইশে রমযান রাতে গোসল করতেন, আর চব্বিশে রমযান সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। তিনি বলতেন, তেইশে রমযান মদীনাবাসীর রাত আর চব্বিশে রমযান বসরাবাসীর রাত।

লাইলাতুল কদরের ব্যাপারে আলেমগণ মতানৈক্য করেছেন। জমহুর আলেমের মতে এটি রমযানের শেষ দশকে। সহীহ হাদীসসমূহ এ মতটিই প্রমাণ করে। তবে শেষ দশকের কোন রাতটি বেশি সম্ভাবনাময় সে ব্যাপারে তারা মতানৈক্য করেছেন। হাসান ও মালিক রহ. থেকে বর্ণিত, তারা বলেন, শেষ দশকের সব রাতেই লাইলাতুল কদর তালাশ করতে হবে। এ মতটি আমাদের অনেক আলেম গ্রহণ করেছেন। তবে অধিকাংশ আলেমের মতে, শেষ দশকের কতিপয় রাত লাইলাতুল কদরের সম্ভাবনাময় রাত। অত:পর তারা বলেছেন, বেজোড় রাতগুলোই বেশি সম্ভাবনাময়। নির্দষ্ট কোন রাত সে ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে স্পষ্ট বাণী নেই।

লাইলাতুল কদরের রাত নির্ধারণ না করার হিকমত –আল্লাহই ভালো জানেন- মুমিনগণ যাতে এ রাতগুলোতে বেশি বেশি ইবাদত করতে পারে। তাই রমযানের শেষ দশকের প্রতিটি রাতকেই লাইলাতুল কদর বলা হয়। লাইলাতুল কদর পাওয়ার আশায় এ শেষ দশকের প্রতিটি রাতে ইবাদতে কঠোর পরিশ্রম করা ও ই‘তিকাফ করা দ্বারা এটিই প্রমাণিত হয়।

লাইলাতুল কদরের সর্বাধিক সম্ভাবনাময় রাত

রমযানের সাতাশ তারিখ লাইলাতুল কদরের সর্বাধিক সম্ভাবনাময় রাত। সহীহ মুসলিমে উবাই ইবন কা’ব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি লাইলাতুল কদর সম্পর্কে বলেন,

«وَاللهِ إِنِّي لَأَعْلَمُهَا، وَأَكْثَرُ عِلْمِي هِيَ اللَّيْلَةُ الَّتِي أَمَرَنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِقِيَامِهَا هِيَ لَيْلَةُ سَبْعٍ وَعِشْرِينَ»

“আল্লাহর কসম আমি এ রাত (লাইলাতুল কদর) সম্পর্কে অধিক জানি। এটি সে রাত যে রাতে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে সালাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। আর এটি সাতাশ তারিখ রাত” (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৬২)

যির ইবন হুবাইশ রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি উবাই ইবন কা’ব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বললাম,

إِنَّ أَخَاكَ ابْنَ مَسْعُودٍ يَقُولُ: مَنْ يَقُمِ الْحَوْلَ يُصِبْ لَيْلَةَ الْقَدْرِ؟ فَقَالَ رَحِمَهُ اللهُ: أَرَادَ أَنْ لَا يَتَّكِلَ النَّاسُ، أَمَا إِنَّهُ قَدْ عَلِمَ أَنَّهَا فِي رَمَضَانَ، وَأَنَّهَا فِي الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ، وَأَنَّهَا لَيْلَةُ سَبْعٍ وَعِشْرِينَ، ثُمَّ حَلَفَ لَا يَسْتَثْنِي، أَنَّهَا لَيْلَةُ سَبْعٍ وَعِشْرِينَ، فَقُلْتُ: بِأَيِّ شَيْءٍ تَقُولُ ذَلِكَ؟ يَا أَبَا الْمُنْذِرِ، قَالَ: بِالْعَلَامَةِ، أَوْ بِالْآيَةِ الَّتِي «أَخْبَرَنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهَا تَطْلُعُ يَوْمَئِذٍ، لَا شُعَاعَ لَهَا»

“আপনার ভাই আব্দুল্লাহ ইবন মাস‘উদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, যে ব্যক্তি গোটা বছর রাত জাগরণ করে সে কদরের রাতের সন্ধান পাবে। তিনি (উবাই) বললেন, আল্লাহ তাকে রহম করুন, এর দ্বারা তিনি একথা বুঝাতে চাচ্ছেন যে, লোকেরা যেন কেবল একটি রাতের ওপর ভরসা করে বসে না থাকে। অথচ তিনি অবশ্যই জানেন যে, তা রমযান মাসে শেষের দশ দিনের মধ্যে এবং ২৭তম রজনী। অতঃপর তিনি শপথ করে বললেন! তা ২৭তম রজনী। আমি (যির) বললাম, হে আবুল মুনযির! আপনি কিসের ভিত্তিতে তা বলছেন? তিনি বললেন, বিভিন্ন আলামত ও নিদর্শনের ভিত্তিতে যে সস্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের অবহিত করেছেন। যেমন, সেদিন সূর্য উঠবে কিন্তু তাতে আলোক রশ্মি থাকবে না।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৬২)

আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

أَنَّ رَجُلًا، أَتَى النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: يَا نَبِيَّ اللَّهِ ، إِنِّي شَيْخٌ كَبِيرٌ عَلِيلٌ، يَشُقُّ عَلَيَّ الْقِيَامُ، فَأْمُرْنِي بِلَيْلَةٍ لَعَلَّ اللَّهَ يُوَفِّقُنِي فِيهَا لِلَيْلَةِ الْقَدْرِ. قَالَ: «عَلَيْكَ بِالسَّابِعَةِ»

একলোক নবী রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর নবী! আমি একজন অসুস্থ বৃদ্ধ মানুষ, দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করা আমার জন্য কষ্টকর। অত:এব, আপনি আমাকে এমন একটি রাতের কথা আদেশ করুন যে রাতে আল্লাহ আমাকে তাওফিক দিলে লাইলাতুল কদর পাবো। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, নিশ্চয়ই তা রমযানের সাতাশ তারিখ।” (মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ২১৪৯। শু‘আইব আরনাঊত হাদীসটিকে বুখারীর শর্তানুসারে সহীহ বলেছেন)

ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত যে,

أَنَّ رِجَالًا مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، أُرُوا لَيْلَةَ القَدْرِ فِي المَنَامِ فِي السَّبْعِ الأَوَاخِرِ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَرَى رُؤْيَاكُمْ قَدْ تَوَاطَأَتْ فِي السَّبْعِ الأَوَاخِرِ، فَمَنْ كَانَ مُتَحَرِّيهَا فَلْيَتَحَرَّهَا فِي السَّبْعِ الأَوَاخِرِ»

“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কতিপয় সাহাবীকে স্বপ্নযোগে রমযানের শেষের সাত রাতে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়। (এ শোনে) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমাকেও তোমাদের স্বপ্নের অনুরূপ দেখানো হয়েছে। (তোমাদের দেখা ও আমার দেখা) শেষ সাত দিনের ক্ষেত্রে মিলে গেছে। অতএব, যে ব্যক্তি এর সন্ধান প্রত্যাশী, সে যেন শেষ সাত রাতে সন্ধান করে”। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২০১৫, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৬৫)

উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«تَحَرَّوْهَا لَيْلَةَ سَبْعٍ وَعِشْرِينَ» يَعْنِي لَيْلَةَ الْقَدْرِ

“তোমরা রমযানের সাতাশ তারিখ লাইলাতুল কদর তালাশ করো।” (মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ৪৮০৮, শু‘আইব আরনাঊত হাদীসটিকে বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে সহীহ বলেছেন)

মু‘আবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে মারফু‘ সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«لَيْلَةُ الْقَدْرِ لَيْلَةُ سَبْعٍ وَعِشْرِينَ»

“সাতাশ রমযান লাইলাতুল কদর।” (আবু দাউদ, হাদীস নং ১৩৮৬, আলবানী রহ. হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন)

ইমাম আহমাদ রহ. এর কাছে কোন তারিখ নির্দিষ্ট না করে বিরত থাকাটাই সহীহ। এ মতের পক্ষে প্রমাণ হলো আবু যার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীস, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে নিয়ে রমযানের শেষ সাতদিন সালাত আদায় করেছেন। তিনি তাদেরকে নিয়ে তেইশ, পঁচিশ ও সাতাশ তারিখ রাতে এত পরিমাণ সালাত আদায় করেছেন যেন মনে হচ্ছিল কল্যাণ তথা সাহরী ছুটে যাওয়ার উপক্রম। তিনি এ সময় তার পরিবার ও লোকদেরকে সালাতে একত্রিত করেছেন। এখানে «الفلاحُ»   মানে সাহরী।

এ রাতের আলামত ও নিদর্শন দ্বারা কেউ কেউ দলিল দিয়ে থাকেন। উপরে উল্লিখিত উবাই ইবন কা‘ব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হাদীসে এসেছে যে, এ দিন ভোরে সূর্য উদিত হবে তবে আলোক রশ্মি থাকবে না। কোন এক সৎলোক সাতাশ রমযান বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করছিল। সে দেখল মানুষের মাথার উপরে ফিরিশতাগণ তাওয়াফ করছে। একলোক অন্ধকারে বারবার কি যেন দেখছিল। তাকে আরেকলোক জিজ্ঞেস করল, আপনি কী দেখছেন? সে বলল আমি কদরের রাত তালাশ করছি। তখন লোকটি তাকে বলল, আপনি ঘুমান। আমি আপনাকে কদরের রাতের সংবাদ দিব। যখন সাতাশ রমযান এলো তখন সে ঐ লোকটিকে নিয়ে খেজুর বাগানে গেল। দেখল খেজুর গাছগুলো জমিনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। তিনি বললেন, কদরের রাত ব্যতীত আমরা সারা বছর গাছগুলোকে এমন দেখি না। এক পঙ্গু এ রাতে আল্লাহর কাছে তার পঙ্গুত্ব ভালো হওয়ার জন্য দো‘আ করছিল। আল্লাহ তার পঙ্গুত্ব ভালো করে দেন। এমনিভাবে এক বোবা লোক ত্রিশ বছর আল্লাহর কাছে দো‘আ করছিলেন। আল্লাহ তার যবান খুলে দেন এবং সে কথা বলতে সক্ষম হয়।

লাইলাতুল কদরের আমল

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«مَنْ قَامَ لَيْلَةَ القَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ»

“যে ব্যক্তি লাইলাতুল ক্বাদরে ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রাত জেগে ইবাদাত করে, তাঁর পিছনের সমস্ত গুনাহ মাপ করা হবে।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯০১)

মুসনাদে আহমাদের বর্ণনায় এসেছে,

فَمَنْ قَامَهَا ابْتِغَاءَهَا إِيمَانًا، وَاحْتِسَابًا، ثُمَّ وُفِّقَتْ لَهُ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ وَمَا تَأَخَّرَ “

“যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রাত জেগে ইবাদাত করবে, অত:পর সে রাত লাভ করার তাওফিকপ্রাপ্ত হবে, তার পিছনের ও পরের সমস্ত গুনাহ মাপ করা হবে।” (মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ২২৭১৩, শু‘আইব আরনাঊত হাদীসটিকে হাসান বলেছেন; তবে দুটি ইবারত ব্যতীত। সে দুটি ইবারত হলো (أَوْ فِي آخِرِ لَيْلَةٍ) এবং (وَمَا تَأَخَّرَ))

নাসায়ীর বর্ণনায় এসেছে,

وَمَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ “

“যে ব্যক্তি লাইলাতুল ক্বাদরে ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রাত জেগে ইবাদাত করে, তাঁর পিছনের সমস্ত গুনাহ মাপ করা হবে।” (নাসায়ী, হাদীস নং ৩৪০৫)

এ রাতের কিয়াম হলো তাহাজ্জুদের সালাত আদায় ও অন্যান্য সালাত আদায় করা। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে দো‘আ করতে নির্দেশ দিয়েছেন।

ইমাম শাফে‘ঈ রহ. বলেন, কদরের রাতের পরিশ্রমের মতো কদরের দিনেও ইবাদতে কঠোর পরিশ্রম আমি মুস্তাহাব মনে করি। ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ أَرَأَيْتَ إِنْ عَلِمْتُ أَيُّ لَيْلَةٍ لَيْلَةُ القَدْرِ مَا أَقُولُ فِيهَا؟ قَالَ: ” قُولِي: اللَّهُمَّ إِنَّكَ عُفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي.

“ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি যদি কদরের রাত পেয়ে যাই তবে কী দো‘আ পড়বো? তিনি বলেন, তুমি বলবে, হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাকারী, তুমি ক্ষমা করতেই ভালোবাসো। অতএব, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও।” (তিরমিযী, ৩৫৩১, ইমাম তিরমিযী রহ. বলেছেন, হাদীসটি হাসান সহীহ। ইবন মাজাহ, ৩৮৫০, আলবানী রহ. বলেছেন, হাদীসটি সহীহ। মুসতাদরাক হাকিম, ১৯৪২)

অতএব, সংক্ষেপে কদরের রাতের আমল হলো:

১। রাতের প্রথমভাগে ইশা সালাত ও তারাবীহ জামাতের সাথে আদায় করা।

২। সাধ্যানুযায়ী ২ রাকাত ২ রাকাত করে নফল সালাত আদায় করা। তবে সংখ্যা নির্দিষ্ট করা যাবে না।

৩। রাতের শেষভাগে তাহাজ্জুদের সালাত ২ রাকাত ২ রাকাত করে সাধ্যানুযায়ী আদায় করা।

৪। সর্বশেষ বিতরের সালাত আদায় করা।

৫। বেশি বেশি কুরআল তিলাওয়াত করা। কারণ এ রাতেই কুরআন নাযিল হয়েছে।

৫। হাদীসে বর্ণিত (اللَّهُمَّ إِنَّكَ عُفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي) হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাকারী, তুমি ক্ষমা করতেই ভালোবাসো। অতএব, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও।” (তিরমিযী, ৩৫৩১) এ দু‘আ পড়া এবং অন্যান্য দু‘আও সাথে পড়া।

৬। সকল কবীরাহ ও সগীরাহ গুনাহ থেকে বেশি বেশি ইসতেগফার করা। পরবতীতে সে পাপে আর ফিরে না যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প করা।

৭। নফল সালাত বিশেষ করে তাহাজ্জুদের সালাতে সিজদারত অবস্থায় বেশি বেশি দু‘আ করা ও আল্লাহর কাছে চাওয়া।

৮। ইবাদত-বন্দেগী করতে গিয়ে সকল প্রকারের বিদ‘আত পরিহার করা। আতশবাজি, মসজিদ বা ঘর সাজানো, আলোকসজ্জা করা, কবরস্থানে বাতি দেওয়া, ইত্যাদি সম্পূর্ণ পরিহার করা।

৯। তারাবীহ ব্যতীত অন্যান্য নফল ইবাদত ঘরে একাকী আদায় করা উত্তম।

১০। এ রাতে বেশি বেশি দান-সদকা করা। কেননা হাজার রাতে দানের সাওয়াবের নিশ্চয়তা এ রাতে রয়েছে।

১১। অতিরিক্ত সালাত আদায় করতে গিয়ে সাহরী ও ফজরের সালাতের জামাত যেন ছুটে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখা।

১২। সর্বোপরি সকল প্রকারের ভালো কাজ বেশি বেশি পরিমাণে করা। কেননা ১টি নেক আমল করলে ৮৩.৩৩ বছর নেক আমল করার সাওয়াব পাওয়া যাবে। তাই বিভিন্ন ধরনের নেককাজে অগ্রগামী হতে হবে।

 

লেখকঃ গবেষক, লেখক এবং  সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, শান্ত-মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়

 

আরও পড়ুন-

লাইলাতুল কদরের আমল ও ফজিলত

লাইলাতুল কদর : মর্যাদা ও করণীয়

লাইলাতুল কদর

আরও পড়ুন