Ads

বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। ৩য় পর্ব

।। জামান শামস ।।

‘বহু বিবাহ’ (Polygamy) অর্থ এমন এক বিবাহ পদ্ধতি যেখানে একজন পুরুষের একাধিক স্ত্রী থাকে। ইসলাম একজন পুরুষকে একাধিক স্ত্রী রাখার কেন অনুমোদন দিয়েছে?

তর আগে বলে নেয়া উচিত যে আল-কুরআন’-ই পৃথিবীতে একমাত্র ঐশীগ্রন্থ, যে নির্দেশ করে, ‘فَاِنۡ خِفۡتُمۡ اَلَّا تَعۡدِلُوۡا فَوَاحِدَۃً আর যদি ভয় কর যে, তোমরা সমান আচরণ করতে পারবে না, তবে একটি মাত্র বিবাহ করো’। এছাড়া আর কোনো ধর্মগ্রন্থে এমন নেই যাতে একটি মাত্র বিবাহ করার নির্দেশ রয়েছে। এক স্ত্রী গ্রহণ সম্পর্কে বেদ, রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বাইবেল, তালমুদ প্রভৃতি ধর্ম গ্রন্থের যে কোনো একটি ধর্মগ্রন্থেও বহু বিবাহ বা স্ত্রীদের সংখ্যার ব্যাপারে কোনো প্রকার নির্দিষ্ট সীমা সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় নি। এসব ধর্মগ্রন্থ অনুসারে একজন পুরুষ যত ইচ্ছে বিবাহ করতে পারে। হিন্দু পুরোহিত ও খ্রিস্টান পাদ্রিগণ অনেক পরে স্ত্রীদের সংখ্যা ‘এক’-এ সীমিত করে দিয়েছে। এক্ষেত্রে কার কতোজন স্ত্রী বা প্রেমিক ছিলো সে পরিসংখ্যান অনাবশ্যক।

এমন সমালোচনাও করা হয়ে থাকে যে, ইসলাম বহু বিবাহ বৈধ করেছে। আসলে ইসলাম বহু বিবাহের একটা সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে, যে কেউ চারটির বেশি বিবাহ করতে পারবে না | কারণ আজ থেকে এক দেড়শ বছর আগে এই ভারতেই অনেক মানুষ ৩০-৫০-৮০ এমন কি একশোর বেশি বিবাহ করত! ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বহু বিবাহ’ ও ‘বাল্য বিবাহ’ বই দুটি পড়ে দেখতে পারেন | আপনি যদি পৃথিবীর ইতিহাস পড়েন তাহলে দেখবেন যে সব যুগেই মানুষ অনেক স্ত্রী বা উপপত্নি রাখত । সে জন্য ডেভেন্পর্ট বলেছেন যে, মুহাম্মদ (সা.) বহু বিবাহ কে সীমার বাঁধনে বেঁধে দিয়েছিলেন।

প্রথম পর্ব –বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। ১ম পর্ব

ইসলাম সুবিচারের শর্তে সর্বোচ্চ চারটি বিবাহকে অনুমোদন দিয়েছে, তবে স্ত্রীগণের মধ্যে সুবিচার নিশ্চিত করতে অপারগ হলে একটি বিবাহ করতে উপদেশ দিয়েছে | সকল ধর্মেই বহু বিবাহ বৈধ | কিন্তু কোনো সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হইনি।অর্থাৎ আপনি যত ইচ্ছা বিয়ে করতে পারেন কোনো আসুবিধা নেই | পাশ্চাত্যের বিখ্যাত দার্শনিক লিটনার তার “মহামেডানিসম” বই এ লিখেছেন,” অপরিমিত বহু বিবাহ প্রথাকে মুহাম্মদ (সা.) রুখে দিয়ে ছিলেন” । তিনি আরো লিখছেন “মুহাম্মদ (সা.) এর আইনের উত্সাহ কিন্তু স্পষ্টতই একটি বিবাহের পক্ষে”। স্পস্ট ভাবে জেনে রাখা উচিত, ইসলাম কিন্তু লাগাম ছাড়া বহু বিবাহ প্রথাকে নিষিদ্ধ করেছে | মধ্যযুগে বল্লাল সেন কৌলিন্য প্রথার মুখোসে যে বহু বিবাহ প্রথার প্রচলন করেছিলেন , সেই প্রথার সুযোগ নিয়ে কুলীন ব্রাহ্মণ শতাধিক বিবাহে মেতে উঠতো ।

আগেই বলেছি,ইসলাম একাধিক বিয়ের অনুমোদন দিয়েছে এবং এর মূলে অনেক বড় বড় জাস্টিফিকেশান রয়েছে। আল্লাহর উইজডম ব্যাখ্যা করা মানুষের সাধ্যাতীত। যারা একাধিক বিয়ের এই অনুমোদনের বিরোধীতা করেন বরং তাদের এ বিষয়ে আরো পড়ালেখা করা উচিত।

প্রথম ভিত্তি প্রথম ভিত্তি হলো,দুনিয়াতে নারী পুরুষ সংখ্যা সমান নয়। এটা আল্লাহ তায়ালারই হিকমাহ যে তিনি নারীদের পুরুষের তুলনায় বেশী জন্ম দেন। প্রত্যেক পরিবারেই নারী সংখ্যা পুরুষের চেয়ে বেশী।আমারও বোনের সংখ্যা ভাই থেকে বেশী,একইভাবে আমার কন্যা সংখ্যা পুত্রের দ্বিগুণ।এটা কেন,এ প্রশ্ন অবান্তর। পরিসংখ্যান দেখায় যে বিবাহের জন্য উপযুক্ত মহিলাদের সংখ্যা প্রায়শই পুরুষদের থেকে বেশি।

দ্বিতীয় পর্ব – বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। ২য় পর্ব

আরো বিবেচ্য যে, পুরুষদের বিশেষ করে যুবকদের মৃত্যু হার মেয়ে ও মহিলাদের মৃত্যুর চেয়ে বেশি। যুদ্ধ-বিগ্রহ,দুর্ঘটনা, ধ্বংসাবশেষের নিচে চাপা পড়ে যাওয়া, ডুবে যাওয়া, খনি ও বিভিন্ন শিল্পের  কাজের সাথে সম্পর্কিত দুর্ঘটনা ইত্যাদির মতো ঘটনাগুলির হতাহতের ঘটনা উল্লেখ করার মাধ্যমে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই দুর্ঘটনাগুলি কম নয়, এতে নারী ও পুরুষের মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং নারীর অনুপাত পুরুষের  চেয়ে বৃদ্ধি পায়। ইরাক ও ইরান, আমেরিকা ও ইরাক, রাশিয়া ও আফগানিস্তানের যুদ্ধ এবং তাদের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ, সার্বিয়া ও বসনিয়া এবং সারা বিশ্বে ঘটে যাওয়া অন্যান্য যুদ্ধ ও আগ্রাসনের মতো সাম্প্রতিক যুদ্ধের মানবহত্যায় এটি স্পষ্ট। এই যুদ্ধগুলিতে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা ভয়ঙ্করভাবে বেশি এবং মৃত ব্যক্তির বেশিরভাগই পুরুষ এবং  এমন অধিকাংশই যুবক  যারা  বিয়ে করেননি বা তাদের মৃত্যুর আগে সম্প্রতি বিয়ে করেছিলেন। এখন এই যুদ্ধের ফলস্বরূপ পুরুষদের তুলনায় নারীদের বৃদ্ধি বিবেচনা করুন। যত যুদ্ধ,যত দূর্ঘটনা তত  অবিবাহিত পুরুষের সংখ্যা হ্রাস (Reducing male ratio) এবং তত বিবাহিত নারীর বৈধব্য লাভ (Becoming widow) ।

দ্বিতীয়ত, কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন যে নারীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পুরুষদের তুলনায় বেশি। শিশু, কিশোর এবং তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের মৃত্যুর অধ্যয়ন এই তত্ত্বকে নিশ্চিত করে। নারীদের গড় আয়ু পুরুষের তুলনায় বেশি। পরিসংখ্যান দেখায় বিধবা পুরুষের তুলনায় বিধবা নারীর হার বেশি।

তৃতীয় পর্ব- বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। ৩য় পর্ব

এইভাবে অবিবাহিত নারীদের সংখ্যা যারা বিয়ে করতে চায় এবং প্রয়োজন তাদের সংখ্যা অবিবাহিত পুরুষদের সংখ্যার চেয়ে বেশি যারা বিবাহের প্রয়োজন এবং ইচ্ছা পোষণ করে। আমরা সকলেই অনেক বিধবা মহিলাকে দেখেছি যারা একজন কাঙ্খিত পুরুষকে পুনরায় বিয়ে করতে চায় কিন্তু পরিস্থিতির কারণে তা করতে পারে না। অন্যদিকে বিবাহ করতে ইচ্ছুক এমন কোন অবিবাহিত পুরুষ নেই যে বিয়ে করতে ইচ্ছুক মহিলা খুঁজে পায় না।

দ্বিতীয় ভিত্তি: সমস্ত মানুষের প্রাকৃতিক অধিকারগুলির মধ্যে একটি হল বিবাহ এবং একটি পরিবার গঠনের অধিকার । মানুষের যেমন চাকরি, বাড়ি, স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা, খাদ্য ও পোশাক পাওয়ার অধিকার রয়েছে, তেমনি তাদের বিবাহেরও অধিকার রয়েছে। সমস্ত মানুষের, পুরুষ এবং মহিলা উভয়েরই বিয়ে করার, পারিবারিক শান্তি ও ভালবাসা উপভোগ করার, দীর্ঘস্থায়ী মানসিক সংযুক্তি গড়ে তোলার এবং বৈধ সন্তান জন্ম দেওয়ার অধিকার রয়েছে। এখন এক পুরুষ সমান এক নারী স্থির হলে এই অতিরিক্ত (Surpluses) নারীরা কোথায় যাবে ?

এক্ষেত্রে হয় সমাজকে অবশ্যই যৌন স্বাধীনতা, দুর্নীতি এবং অসংযম আচরণ মেনে নিতে হবে ।  এক কথায় পাবলিক প্রপার্টি হতে হবে; যেমনটি পশ্চিমে গৃহীত হয়েছে অথবা ইসলামের মতো, একটি বহুবিবাহ ব্যবস্থা অনুসরণ করতে হবে।

চতুর্থ পর্ব – বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। চতুর্থ পর্ব

বহুবিবাহের আরেকটি ন্যায্যতা হল একজন পুরুষের স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব বা অক্ষমতা। যদি কোনও মহিলা সম্পূর্ণরূপে জীবাণুমুক্ত বা গর্ভাবস্থা একটি দুরারোগ্য অসুস্থতার কারণে তার পক্ষে ক্ষতিকারক হয় এবং তার স্বামী একটি সন্তানের প্রয়োজন অনুভব করেন তখন পারিপার্শ্বিক কারণ এবং বিবেক উভয়ই তার পুনর্বিবাহের অধিকারে সম্মতি দেয়। আমি এমন বহু পরিবার জানি যারা কেবল বন্ধ্যাত্ব নিশ্চিত হবার কারণে দ্বিতীয় বিয়েতে উৎসাহিত হয়েছে এবং এখন সন্তান নিয়ে সুখে আছে।

এটাও বিবেচ্য যে যদি একজনের স্ত্রী অসুস্থ হয় এবং তার স্বামীর যৌন চাহিদা পূরণ করতে না পারে, তাহলে পুনরায় বিয়ে করা পুরুষের জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য, পুরুষকে হয় তার প্রথম স্ত্রীকে তালাক দিতে হবে অথবা তাকে তালাক না দিয়ে আবার বিয়ে করতে হবে। দ্বিতীয় বিকল্পটি প্রথম স্ত্রীর জন্য সুবিধার কেননা তিনি তার অসুস্থতায় নিঃস্ব এবং একা হয়ে যান না।

পঞ্চম পর্ব–বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। পঞ্চম পর্ব

তবুও, এটা জোর দেওয়া উচিত যে বিয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল পারিবারিক প্রেম, প্রশান্তি এবং স্নেহ। এই সত্যের আলোকে, বহুবিবাহের চেয়ে একবিবাহ অনেক বেশি পছন্দনীয়। অধিকন্তু, ইসলাম পুরুষদের তাদের বিবেক তুষ্ট করার জন্য পুনর্বিবাহ করতে এবং অপ্রকাশিত আনন্দের জন্য পারিবারিক প্রেম ও শান্তি বিসর্জন দিতে উৎসাহিত করে না। ইসলাম বহুবিবাহকে স্বীকার করার কারণ হল একটি সামাজিক সুস্থিতি ও পবিত্রতা। বিধবাদের অগ্রাধিকার দিলে এটা আরো কল্যাণকর যে তারা স্ত্রর সুযোগ সুবিধা ও অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারে।

দ্বিতীয় বিয়ের জন্য শরীয়াহ প্রথম স্ত্রীর অনুমতিকে আবশ্যক করে না যদিও আইনে তা বর্ণিত আছে। এটা সাধারণ ভব্যতা ও ভবিষ্যত ঝামেলা এড়াতে তাকে অবশ্যই তার বর্তমান স্ত্রীর সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে হবে এবং তার পুনর্বিবাহের প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করতে হবে ।  তাকে আশ্বস্ত করতে হবে যে তিনি তার স্ত্রীদের মধ্যে ন্যায়বিচার ও সমতা পালন করবেন।

ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রয়োজনীয়তা নিশ্চিত করার জন্য এই ধরনের স্ত্রীর কর্তব্য হল আত্মত্যাগ । তাকে অবশ্যই কঠোর আবেগকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে । তার স্বামী বা বিধবা নারীদের দুর্দশা এবং চাহিদার কথা মাথায় রাখতে হবে এবং সর্বোপরি, তাকে অবশ্যই আল্লাহর সন্তুষ্টির কথা ভাবতে হবে এবং এইভাবে তার স্বামীকে, তার বৈধ অনুরোধের অনুমতি দিতে হবে। যদি স্বামী ও স্ত্রীর পারস্পরিক সম্মতির মাধ্যমে পুনর্বিবাহ হয়, তাহলে আশা করা যায় যে এই বিষয়ের সাথে জড়িত সকলের জন্য এটি অনেক কম সমস্যাযুক্ত হবে।

চলবে…।

ষষ্ঠ ও শেষ পর্ব-বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। ষষ্ঠ ও শেষ পর্ব

লেখকঃ জামান শামস, কলাম লেখক এবং সাবেক এডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ,পরিবার ও আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা ও আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। প্রিয় লেখক! আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; প্রিয় লেখক ও পাঠক আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন । আসুন সুস্থ ও সুন্দর সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

আরও পড়ুন