Ads

শিক্ষার্থীরা সহিংস হচ্ছে কেন? 

।। এইচ বি রিতা ।।

শিক্ষক জাতি গঠনের কারিগর। শিক্ষাদানের মহান ব্রত যার কাজ তাকেই শিক্ষক বলা হয়। আর শিক্ষার্থী হলো সেইজন যে স্কুল বা অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিক, মানবিক জ্ঞান অর্জন, সামাজিক যোগাযোগ রক্ষা, পেশাগত বিকাশ এবং কাঙ্ক্ষিত ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে শিক্ষার অধীনে নিযুক্ত থাকেন। একজন শিক্ষার্থীর উন্নত ভবিষ্যত গড়ে তুলতে শিক্ষকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সেই শিক্ষার্থী যখন শিক্ষকের গায়ে হাত তোলে কিংবা সহিংস হয়, তখন বিষয়টা নিয়ে ভাবতে হয়।

বাংলাদেশে একজন শিক্ষকের গায়ে কোন শিক্ষার্থী হাত তুললে বা গালাগালি করলে আমরা প্রতিবাদে শিক্ষার্থীর শাস্তি চাই। শিক্ষকের সাথে দ্বন্ধ মানেই সব অপরাধ শিক্ষার্থীর। একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষকের গায়ে হাত তুলছে বা গালি দিচ্ছে-বিষয়টা ন্যাক্কারজনক। অনৈতিক এবং অমানবিক। এই আচরণের দায়ভার কিন্তু শিক্ষার্থীর একার নয়, কিছুটা পরিবারের, কিছুটা সমাজের, রাষ্ট্রের এবং কিছুটা শিক্ষকদের। মূলত পরিবার এবং স্কুল-দুই দিক থেকেই একজন শিক্ষার্থী জন্মের পর থেকে শিখতে শুরু করে। আবার সেই শেখায় পরিবেশগত দূষণ, সামাজিক দুরাবস্থা একজন শিক্ষার্থীকে বিপথে নিয়ে যেতে পারে। একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষককে সম্মানে না রেখে কেন এমন বিরূপ আচরণ করছে? মূল সমস্যাটা আসলে কোথায়, তা আমরা প্রায়শই খুঁজে পেতে ব্যর্থ হই।

একজন শিক্ষকের প্রতি শিক্ষার্থীর অসম্মানমূলক বা হিংস্র আচরনের পিছনে একাধিক কারণের মধ্যে একটি হলো, ভুল রাজনীতি। দেশের শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি থাকা, না থাকা নিয়ে তর্ক বিতর্ক আছে। আমরা যদি ইতিহাস ঘাটি তবে দেখতে পাই যে, ঔপনিবেশিক ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সমাজের সচেতন নাগরিক হিসাবে রাজনৈতিক সংগ্রামে ছাত্রসমাজের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। আমাদের ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, ১১ দফার আন্দোলন সহ মুক্তিযুদ্ধে-ছাত্রসমাজ গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে। ইউরোপ-আমেরিকার মতো দেশগুলোতেও ছাত্রসমাজ রাজনীতিতে যুক্ত হচ্ছে। কিন্তু তাদের সাথে আমাদের ছাত্ররাজনীতির ব্যাপক পার্থক্য। বাইরের এমন অনেক দেশ আছে যেখানে শিক্ষার্থীদের রাজনীতির মূল বিষয় হলো-যুদ্ধবিরোধী মানবতাবাদী ভূমিকা এবং সমাজ বিপ্লবের ভাবাদর্শ। সে অর্থে, আমাদের দেশের রাজনীতিতে ছাত্রসমাজকে ক্ষমতায় যাওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।রাজনৈতিক দলীয় ভাবাদর্শ আর স্বার্থসিদ্ধিতে তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে করে ছাত্রসমাজ পড়াশোনাকে তপস্যা হিসেবে গ্রহণ না করে, উচ্ছৃঙ্খলতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, নির্যাতন, পরীক্ষায় দুর্নীতি, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাস্তানি, অপরাধপ্রবণতা দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। শিক্ষাঙ্গনে এবং ছাত্রসমাজে সুস্থ ধারার রাজনীতির বদলে, দলীয় ও ক্ষমতার রাজনীতি ঢুকে পড়েছে যা শিক্ষাক্ষেত্র এবং শিক্ষার্থী-উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর। আমরা বুয়েটের আবরার হত্যার একটা উদাহরণ টানলেই সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারি।

এ তো গেল ছাত্র সমাজের কথা। যেসব শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ে, তারা রাজনীতিতে অংশ নেবার বয়সসীমায় যায় না। সেসব শিক্ষার্থীদের আচরণেও সহিংসতা দেখা যায়। মূলত, পারিবারিক শিক্ষার অভাব, সামাজিক অবস্থান ও পার্যায়ক্রম, পরিবেশ, আর্থিক সঙ্কট, শারীরিক ও মানসিক সমস্যা, শিক্ষা ব্যবস্থা এবং শিক্ষকদের বিরূপ ভূমিকা- অস্বীকার করার উপায় নেই।

বাইরের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার পার্থক্য ব্যাপক। বাইরের দেশগুলোতে একজন শিক্ষার্থীর সার্বিক উন্নয়ন ও সুস্থ ভবিষ্যৎ নিশ্চিতকরণে কেবল পাঠ্যপুস্তক মুখস্ত করে পরীক্ষায় পাস হবার চাপ থাকে না। বরং একজন শিক্ষার্থী কীভাবে পড়াশোনার পাশাপাশি, সামাজিক দক্ষতা ও ক্যারিয়ার বিল্ডআপ করবে, তাও নিশ্চিত করা হয়, যা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নেই। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় থাকে একাডেমিক স্ট্রেস।একাডেমিকভাবে ভাল পারফর্ম করার চাপ, শিক্ষার্থীদের হতাশা এবং উদ্বেগের দিকে নিয়ে যায়, যা কখনো আক্রমনাত্মক আচরণ হিসাবে প্রকাশ হতে পারে।

এই চাপ শিক্ষার্থীদের একার নয়, পিতা-মাতাদেরও মানসিক এবং আর্থিক চাপে ফেলে। আর্থ-সামাজিক কারণগুলি, যেমন-অর্থনৈতিক বৈষম্য, দরিদ্রসীমায় বাস করা, শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অ্যাক্সেসের অভাব এবং সুবিধাবঞ্চিত এলাকায় অপরাধের সংস্পর্শ, শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহিংস আচরণে অবদান রাখতে পারে। যে সকল শিক্ষার্থীরা পরিবেশগত বা বন্ধু, স্কুলের অন্য শিক্ষার্থীদের দ্বারা হয়রানির শিকার হয়, তারা আত্মরক্ষার উপায় হিসেবে সহিংসতা অবলম্বন করতে পারে বা তাদের নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ হিসাবে সহিংস হয়ে উঠতে পারে।

লেখকের আরও লেখা পড়ুন- আমাদের আর পশুর মাঝে ব্যবধান শুধু বিবেকবোধের

শারীরিক ও মানসিক সঙ্কটের উপযুক্ত চিকিৎসা না পাওয়া, যত্ন না পাওয়াও একজন শিক্ষার্থীকে আচরণগত ব্যাধি (conduct disorders) বা আবেগ নিয়ন্ত্রণ সমস্যায় (impulse control issues) ফেলতে পারে। আচরণের ব্যাধিযুক্ত শিশু-কিশোর, তরুণদের পক্ষে নিয়ম মেনে চলা এবং সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য উপায়ে আচরণ করা কঠিন হয়ে উঠে। তাদের আচরণ প্রতিকূল হয় এবং কখনও কখনও এর জন্য শারীরিকভাবে সহিংসতাও প্রকাশ করতে পারে।

শিক্ষকদের দক্ষতার কথা বলতে গেলে, একজন দক্ষ শিক্ষকই পারেন একজন শিক্ষার্থীর জীবনে ভিন্নতা আনতে যা শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষের শিক্ষা থেকে শুরু করে তাদের দীর্ঘমেয়াদী সাফল্য পর্যন্ত সবকিছুকে প্রভাবিত করে। একজন দক্ষ শিক্ষকের কিছু গুণাবলীর মধ্যে রয়েছে শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা, তাদের কথা শোনা, ইতিবাচক ভূমিকা, সহযোগিতা করা, অভিযোজন ক্ষমতা, সহানুভূতি প্রদর্শন করা, প্যারেন্টসদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা এবং ধৈর্য ধারণ করা। সেই সাথে আকর্ষক একটি শ্রেণীকক্ষের উপস্থিতি দরকার যা বাস্তব-বিশ্বকে জানতে ও শিখাতে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করবে এবং সর্বোত্তম অনুশীলন বিনিময় করবে। এই অনুশীলনে শিক্ষার্থীদের জন্য দ্বন্দ্ব সমাধানের দক্ষতাও বৃদ্ধি হয়। তা না হলে শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে দ্বন্দ্ব সমাধান করতে ব্যর্থ হয়, যা একটি ডিফল্ট প্রতিক্রিয়া হিসাবে তাদেরকে সহিংসতার দিকে পরিচালিত করে। একজন শিক্ষককের জন্য এইসব বিষয়ে দক্ষতা থাকা জরুরি। দেশের শিক্ষকদের নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। তবে দক্ষ শিক্ষকও রয়েছে। যাদের নিযে অভিযোগ, তাদের দিকে শিক্ষা বিভাগের আরো মনোযোগ দেয়া দরকার এবং একজন দক্ষ শিক্ষক হিসাবে গড়ে উঠায় তাদের জন্য কার্যকরী ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণগুলো সরবরাহ করা দরকার, যাতে তারা শিক্ষার্থীদের প্রতি শাসক না হয়ে  বরং বন্ধুত্বপরায়ন হয়ে উঠতে পারেন এবং কার্যকরী উপায়ে শিক্ষা প্রদান করতে পারেন।

বাইরের দেশগুলোতে শিক্ষকতায় মনোবিজ্ঞান অধ্যয়ন করতে হয়। অর্থাৎ ‘চাইল্ড সাইকোলোজি’, সাইকোলোজিক্যাল প্র্যাকটিস’, ‘হিউম্যান মাইন্ড এন্ড বিহেভিয়্যার’ ইত্যাদি বিষয়গুলো পড়তে হয়। এজন্য পড়তে হয় যে, একজন শিক্ষার্থীকে শিক্ষা প্রদানের সাথে তার মনকে পড়তে জানা  জরুরি বলে মনে করা হয়। এবং প্রতিটা স্কুলে শিক্ষার্থীদের সুরক্ষায় গাইডেন্স কাউন্সেলর, সাইকোলিস্ট এবং নার্স নিযুক্ত থাকে। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষকদের জন্য  মনোবিজ্ঞান অধ্যয়ন করা বাধ্যতামূলক নয়। এই পাঠটি শিক্ষকতায় যুক্ত না বলে, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে অভ্যন্তরীন যোগাযোগের ঘাটতি থেকে যায়। একজন শিক্ষার্থীকে উন্নত ও উপযুক্ত শিক্ষা দিতে, তার মনস্তত্ত্ব বোঝতে হবে। একজন শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীদের মন ও মনের অবস্থা বুঝতে না পারেন, তবে তিনি সময় ও পরিস্থিতি সাপেক্ষে তাদের সঠিক শিক্ষা প্রদান করতে পারবেন না, কিংবা দিলেও সেটা ঠিক প্রতিকূল অবস্থায় শিক্ষার্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। পড়াশোনায় শেখাতে এবং সাফল্য আশা করার আগে মানসিক স্বাস্থ্য সুস্থ রাখা কিংবা সুস্থ আছে কিনা, তা জানা দরকার। শিক্ষকতা পেশায় মনোবিজ্ঞান অধ্যয়ন শিক্ষকদের জন্য জরুরি।

নিজ পর্যবেক্ষণ, প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে যদি বলি, আমেরিকার শিক্ষা ব্যবস্থা ও পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এদেশে, একজন শিক্ষার্থী যদি ক্লাসে শিক্ষকের সাথে উগ্র বা নেতিবাচক আচরণ প্রদর্শন করে (বিশেষ করে ষষ্ঠ শ্রেনি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি) তবে সেটা নিয়ে শিক্ষার্থীর সাথে ইতিবাচকভাবে স্কুলের ডিন আলোচনা করেন। যদি আচরণ না বদলায় তবে বাবা-মায়ের সাথে বিনয় ও সম্মানের সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করা হয়। এরপরও যদি শিক্ষার্থীর একই আচরণ অব্যাহত থাকে, তখন তাকে সাময়িকের জন্য ক্লাস থেকে সাসপেন্ড করার নোটিশ দেয়া হয়। এবং সর্বশেষ যদি বিরূপ আচরণ তখনো অব্যাহত থাকে, সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর সহিংসতার পরিস্থিতি অনুযায়ী অল্প সময়ের জন্য বা পার্মানেন্ট সাসপেন্ড করা হয়। অল্প সময়ের সাসপেন্ডে শিক্ষার্থীকে স্কুল ছুটির দিনগুলোতে কয়েক ঘন্টার জন্য স্কুল বিল্ডিংয়ে কাজ করতে নিযুক্ত করা হয়। কখনো আচরণ স্বাভাবিক করতে অন্য একটি স্কুলে পাঠানো হয় যেখানে শিক্ষার্থীদের আচরণগত সমস্যাগুলোকে ফিক্স করা হয়। সাথে নিয়মিত শিক্ষক এবং পাঠসূচীও থাকে।

স্পেশাল স্কুলগুলোতে একটু ভিন্ন পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। কোন শিক্ষার্থী যদি ক্লাসে হিংস্র আচরণ বা শারীরিক সহিংসতা প্রদর্শন করে, যেমন গায়ে হাত তোলা, গালির পুনরাবৃত্তি করা, হুমকিমূলক কথা বলা যা অন্য শিক্ষার্থীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং শিক্ষক যদি সেটা মোকাবেলা করতে হিমশিম খান, তখন ‘ক্রাইসিস মেনেজমেন্ট শিক্ষক’ কে ডাকা হয় সাহায্যের জন্য। সেই শিক্ষক আচরণগত সঙ্কট মোকাবেলার জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষণরত থাকেন। তিনি তখন শিক্ষার্থীকে আলাদা কক্ষে নিয়ে সময় দিয়ে তার মেজাজ পরিবর্তনের চেষ্টা করেন। যদি সেটা কাজ না করে, তখন স্কুল কাউনসেলর/সাইকোলোজিস্ট এর কাছে নেয়া হয় ৩০/৪৫ মিনিটের জন্য। ইতিবাচকভাবে আলোচনার মাধ্যমে, প্রয়োজনে কখনো ট্রিট দিয়ে কাউনসেলর তখন খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন, তার এমন আচরণের পিছনের অন্তর্নিহিত কারণটি। শিক্ষার্থীর ব্যাকগ্রাউন্ড অর্থাৎ শিক্ষার্থী কি আজ সকালে নাস্তা সেরে স্কুলে এসেছে কিনা, সে কি বাবা মায়ের সাথে বাস করছে নাকি বিচ্ছিন্ন পরিবারে কিংবা শেল্টারে, সে কি পিতা-মাতাহীন কিনা, সে কি বৃদ্ধ গ্র্যানপেরেন্টসদের সাথে থাকছে কিনা যেখানে তার সঠিক যত্ন হচ্ছে না, সে পরিবারে আর্থিক সঙ্কট মোকাবেলা করছে কিনা, সে পরিবারে অবহেলিত কিনা, অবহেলিত হলে কেন সে অবহেলিত, পিতা মাতা কি কারণে সন্তানকে মনোযোগ দিতে পারছেন না, পিতা-মাতা মানসিকভাবে সুস্থ কিনা, পিতা-মাতার আর্থিক স্বচ্ছলতা আছে কিনা, সে কি স্কুলে বা বাসে কারো দ্বারা বুলিং-এর শিকার কিনা, সে কি ক্লাসে শিক্ষকের দ্বারা অবহেলিত কিনা…. এমন বহু পিছনের কারণগুলো খতিয়ে দেখা হয় শুধুমাত্র শিক্ষার্থীর বিরূপ আচরণের কারণ খুঁজে পেতে। অর্থাৎ শুরুতেই শাস্তি নয় বরং আলোচনার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীর মানসিক অবস্থা বুঝতে এবং এমন আচরণের মূল কারণ ও উৎপত্তি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা হয়। তারপর প্রয়োজনে পরিবারে যোগাযোগ করা হয়। এক্ষেত্রে পরিবারের যে কোন সঙ্কট বা প্রয়োজনে শিক্ষক, পেরেন্ট কো-অর্ডিনেটর এবং সোশ্যাল ওয়ার্কার জড়িত হোন। যদি শিক্ষার্থী তার পরিবারে সঠিক ডাইডেন্স না পায় বা অবহেলিত থাকে, তবে পিতা-মাতাকে ‘প্যারেন্টিং ওয়ার্কশপ’ প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। যদি পরিবারে আর্থিক সঙ্কট থাকে যা শিক্ষার্থীকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে, তবে পেরেন্ট কো-অর্ডিনেটর যতটা সম্ভব পিতা-মাতাকে সরকারী আর্থিক সাহায্য পেতে বিভিন্ন সোর্স প্রদান করেন। এবং তারপরও যদি শিক্ষার্থীর আচরণ পরিবর্তন না হয় সেক্ষেত্রে প্যারেন্টস এর সাথে মিটিং করে সর্বশেষ সমাধান হলো-অল্প সময়ের জন্য শিক্ষার্থীকে ক্লাস থেকে দূরে রাখা।

আমাদের সময়ে শিক্ষক মানেই, অদ্ভুত কিছু। শিক্ষকের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না, দ্বিমত পোষণ করা যাবে না, শিক্ষক কটাক্ষ করলে বা গায়ে হাত তুললে সেটা মেনে নিতে হবে, অভিযোগ করা যাবে না, শিক্ষকের কথার উপর অভিভাবক কোন কথা বলতে পারবেন না..ইত্যাদি নানা বিষয়ে জটিলতা ছিল। মূলত এগুলো ‌অনুচিত এবং ভালো কোন ফলাফল বহন করে না। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর মাঝে সম্পর্কটা হতে হয় বিশ্বাস, আস্থা, সম্মান এবং বোঝাপড়ায় আদান প্রদানের। যখন শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকদের বিশ্বাস করবে, ভরসা করবে এবং প্রশ্ন করতে ও জানতে উন্মুক্ত হবে, তখন তারা শিক্ষকদের নির্দেশাবলী এবং তাদের জন্য শিক্ষকদের যে কোনো পরামর্শ অনুসরণ করার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

শিক্ষকদের, শিক্ষার্থীদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা মানে তাদের বিশ্বাস জয় করার দ্রুততম উপায়। অধিকন্তু, এটি শিক্ষার্থীদেরকে তাদের শিক্ষকদের উপস্থিতি আরো আরামদায়ক করতে পারে এবং শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদেরকে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে সহায়তা করতে পারে। আর এই বিষয়গুলোকে বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে কার্যকরী করে তোলতে শিক্ষকদের জন্য মনোবিজ্ঞান অধ্যয়ন করা, স্কুল কলেজগুলোতে মেজর সাবজেক্ট ছাড়াও বেসিক মনোবিজ্ঞান পড়ানো খুব জরুরি।

নিজ সন্তানের উন্নত ভবিষ্যতের জন্য অভিভাবকদের দায়িত্ব অপরিহার্য। সন্তানের উন্নতির জন্য শিক্ষকদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা, সন্তান ঠিকমত ক্লাসে যাচ্ছে কিনা, ক্লাসের নিয়ম মেনে চলছে কিনা, পরীক্ষার ফলাফল কেমন হচ্ছে, সন্তানের শিক্ষায় কোন ঘাটতি আছে কিনা, থাকলে সেটার উপর মনোযোগ দেয়া…ইত্যাদি বিষয়গুলোর উপর অভিভাবকদের মনোযোগ দিতে হবে। আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পারিবারিক সহিংসতা। কোন পরিবারে যদি অভিভাবকদের মাঝে সহিংসতা বা হিংস্র আচরণ প্রদর্শিত হয়, তবে সেটা সন্তানদের উপর প্রভাব ফেলবে। তারা মনে করতে পারে যে, সহিংসতা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া যা পরবর্তিতে তাদেরকে বন্ধত্ব স্থাপনে, সম্পর্ক ধরে রাখায়, বিশ্বাস স্থাপনে এবং সামাজিক সম্প্রীতি বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। কখনো এই আচরণগুলো তাদের মাঝে হতাশা ও উদ্বেগের সৃষ্টি করতে পারে। যে তার পরিবারের সদস্যদের মাঝে একে অন্যকে সম্মান প্রদর্শন করতে দেখবে না, সে বহির্বিশ্বের অন্যকে কীভাবে সম্মান করতে শিখবে?

লেখকের আরও লেখা পড়ুন- শুধু মুনিয়া নয়, আদিকাল থেকেই নারীরা সমাজে ভোগপণ্য

সহিংসমূলত আচরণের কারণে আমাদের সন্তানরা সমাজে অবহেলিত হতে পারে যা তাদের মানসিক অবস্থাকে আরো ঝুঁকিতে ফেলতে পারে এবং অপরাধ বৃদ্ধি করতে পারে। এমনকি এইসব পরিস্থিতিতে বাচ্চারা স্কুলের পড়াশোনায় মনোযোগ হারাতে পারে, পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল সহ অন্যদের প্রতি সহানুভূতি হারিয়ে ফেলতে পারে। কাজেই অভিবাবকদের এইসব বিষয়গুলোতে সতর্ক হওয়া দরকার। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের জন্য বিভিন্ন পেরেন্টিং প্রশিক্ষণ নেয়া উপকারী হতে পারে। এইসব প্রশিক্ষণগুলো প্যারেন্টসদের জন্য উন্মুক্ত রাখতে সরকারকেই শিক্ষাবিভাগে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করতে হবে। এছাড়াও, মিডিয়ার এক্সপোজার অর্থাৎ ভিডিও গেম, চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন সহ মিডিয়াতে সহিংস বিষয়বস্তুগুলো শিক্ষার্থীদের সহিংসতার প্রতি সংবেদনশীল করতে পারে বা আক্রমণাত্মক আচরণ বৃদ্ধি করতে পারে। কাজেই অভিভাবকদেরকে তাদের সন্তানের দৈনিক কার্যবিধি সম্পর্কেও মনোযোগী হওয়া দরকার। সন্তানরা ইন্টারনেটে কি করছে, কতটা সময় দিচ্ছে, কি ধরণের কনটেন্টের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করছে, তা একটা নির্দিষ্ট নিয়ম ও শৃঙ্খলায় রাখা দরকার। সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহার এবং নিয়মিত সামাজিক যোগাযোগ রক্ষায় বাইরে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা- অভিভাবকত্বের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।  সেইসব বিনোদনমূলক সময় থেকে কিছুটা সময় কাট করে সন্তানদের জন্য বরাদ্দ রাখা-অভিভাবকদের জন্য উপরারী হতে পারে। সন্তানদের যথেষ্ট সময় দেয়া, তাদের সাথে কমিউনিকেশন করা খুব জরুরি। তাছাড়া, পরিবেশগত প্রভাব তো থাকছেই। আমাদের সন্তানরা কার সাথে মেলামেশা করছে তাও দেখা দরকার। বিরুপ পরিবেশে উশৃঙ্খল কারো সাথে মেলামেশা করলে কিংবা ভুল কিছু করলে সেক্ষেত্রে সরাসরি বাধা বা হুমকি না দিয়ে ইতিবাচকভাবে তাদেরকে ভালো-মন্দের পার্থক্যটা বোঝাতে হবে। এখানেই অভিভাবকদের জন্য কমিউনিকেশন দক্ষতা থাকা এবং সঠিক প্যারেন্টিং দক্ষতা থাকা জরুরি হয়ে উঠে। পড়াশোনার বাইরের সময়টুকুতে ‌বাচ্চাদের পছন্দের কাজে ব্যস্ত রাখা, যেমন-খেলাধুলা, জিম, সংগীত, বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখা, পেইন্টিং..ইত্যাদি কাজগুলো তাদেরকে মানসিকভাবে প্রশান্তি দিতে পারে এবং নেতিবাচক বা সহিংস কাজগুলো করা থেকে বিরত রাখতে পারে। সন্তানের সুস্থ নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য এসব বিষয়গুলো নিয়ে অভিভাবকদের ভাবতে হবে। তবে, এসব কাজেও অভিভাবকদের আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকা, গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আর্থিক সঙ্কটে থাকা পরিবারের জন্য এসবে বাড়তি খরচ বহন করা কঠিন। সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারী কিছু ফ্রি-প্রোগ্রাম থাকলে, সেটা অভিভাবকদের জন্য সহায়ক হতে পারে। প্রজন্মকে উন্নত ভবিয়্যত দিতে, সরকারকে এসব খাতে বিনিয়োগ করা দরকার।

শিক্ষার্থীদের নৈতিক, মানবিক গুণাবলীতে সহানুভূতিশীল হতে এবং তাদের সার্বিক ভবিষ্যৎ উন্নয়নে, পড়াশোনায় ফ্রি-টিওশনের ব্যবস্থা রাখা, দরিদ্র পরিবারগুলোতে শিক্ষার উপকরণগুলোর অ্যাক্সেস দেয়া, ক্যারিযার প্রশিক্ষণ নিশ্চিতকরণ, স্কুলে বুলিং প্রতিরোধ ব্যবস্থা, স্বাচ্ছন্দময় শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষার্থীদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে শিক্ষকদের মনোবিজ্ঞান ‌অধ্যয়ন করা বাধ্যতামূলক করা, মাসে অন্তত একটা হলেও শিক্ষকদের জন্য নতুন পদ্ধতিগত শিক্ষা প্রদানের কৌশলগুলির প্রশিক্ষণ দেয়া, শিক্ষার্থীদের বিরূপ আচরণ রোধে শিক্ষকদের ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট প্রশিক্ষণ দেয়া, প্রতিটা স্কুলে নার্স, মেন্টাল হেল্থ কাউনসেলর এবং ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট শিক্ষক নিযুক্ত করা, শিক্ষার্থীর অগ্রগতি-পতন নিয়ে অভিভাবকদের সাথে বছরে তিনবার ‘পেরেন্ট টিচার মিটিং’ এর ব্যবস্থা করা এবং অভিবাবকদের জন্য বিভিন্ন পেরেন্টিংমূলক প্রশিক্ষণ এর সুযোগ রাখা-অত্যন্ত জরুরি।  আমাদের প্রজন্মকে উন্নত একটি ভবিষ্যৎ উপহার দিতে এইসব বিষয়গুলো বিবেচনা করা শিক্ষা বিভাগ এবং রাষ্ট্রের দায়িত্বে পড়ে। আর এবাবেই পরিবার, স্কুল, শিক্ষক, সামাজিক ব্যবস্থা, শিক্ষা বিভাগ এবং সরকারী সহযোগীতা-আমাদের নতুন প্রজন্মকে কিছুটা হলেও সহিংস আচরণ থেকে রোধ করতে সক্ষম হবে।

লেখকঃ যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক, শিক্ষক ও সাংবাদিক (প্রথম আলো)

(লেখাটি প্রথম আলোতে পূর্ব প্রকাশিত)

 

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ,পরিবার ও আত্মউন্নয়ন মূলক অসাধারণ লেখা ও আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi এ লাইক দিন।প্রিয় লেখক!আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; প্রিয় লেখক ও পাঠক আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন ।

 

 

আরও পড়ুন