Ads

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

মোস্তফা মাসুম তৌফিক

আজ ১৭ এপ্রিল। বাঙালি বা বাংলাদেশী জাতির জন্য একটি স্মৃতিমধুর দিবস। এই দিনে আমাদের প্রিয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এর প্রথম সরকার শপথ গ্রহন করেন।

ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম গণহত্যা কিংবা আরও স্পষ্ট করে বললে ভয়ংকর জেনোসাইড এর সূচনা হয় ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে। আর ২৬ মার্চেই ঘোষিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। যদিও ঐতিহাসিক ৭ মার্চের মহাকাব্যিক ভাষণ কেও অনেকে স্বাধীনতার ঘোষণা বলে। তবুও ২৬ মার্চই আমাদের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। বঙ্গবন্ধুর ওয়ারলেস মেসেজ ইপিআর এর মাধ্যমে, চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি আঃ হান্নান মাইকিং করে এবং মেজর জিয়া কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রে প্রচারিত ঘোষণার চুড়ান্ত রূপটি ছিল, “আই অ্যাম মেজর জিয়া, অন বিহাফ অব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ডিক্ল্যায়ারিং দ্য ইনডিপেনডেন্স অব বাংলাদেশ”।

২৫ মার্চ থেকে শুরু হওয়া ক্র্যাকডাউনের এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু তার ডাকে স্বাধীনতার দাবী নিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, যাকে আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধ বলি। আর এই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে দেশকে শত্রু মুক্ত করার দুরূহ দায়িত্ব কাঁধে নিয়েই আমাদের মুজিব নগর সরকারের পথচলা শুরু।

অনিবার্য কারনেই আমাদের মুজিবনগর সরকার ছিলো প্রবাসী সরকার। এই সরকার গঠিত হয় ভারতের কোলকাতায় ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলেই। ১১ এপ্রিল, ১৯৭১ এই প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের ভাষণ আকাশবাণীতে প্রচারিত হয়। কিন্তু আমাদের প্রবাসী সরকার বাংলাদেশের ভূখণ্ডেই নবগঠিত সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তাই সরকার গঠনের ঠিক এক সপ্তাহ পরে ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে এই ঐতিহাসিক শপথ অনুষ্ঠান হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধুর নামের সাথে মিলিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বৈদ্যনাথতলার নাম দেন মুজিবনগর। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজধানীও ছিল এই মুজিবনগর। প্রবাসী সরকারের বিভিন্ন চিঠি পত্রে সরকারের ঠিকানা দেয়া হত, “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, মুজিবনগর”। এরপর থেকে এ জায়গার নামই হয়ে যায় মুজিবনগর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামের সাথে মিলিয়ে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে নতুন সরকার গঠিত হয়। মন্ত্রী হিসেবে আরও ছিলেন খন্দকার মোশতাক ( পররাষ্ট্র), ক্যাপ্টেন মুহাম্মদ মনসুর আলী (অর্থ), এএইচএম কামরুজ্জামান (স্বরাষ্ট্র, ত্রান ও পূনর্বাসন)। কর্নেল (অবঃ) এম এ জি ওসমানী কে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করা হয় এবং মুক্তিবাহিনীকে ১১ টি সেক্টরে ভাগ করা হয়।

অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয় এবং ২৬ মার্চ, ১৯৭১ থেকেই এই সরকারকে কার্যকর ধরা হয়। ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম ছিলেন ঘোষণাপত্রের রচয়িতা এবং তা পাঠ করেন সংসদীয় দলের চিফ হুইপ ইউসুফ আলী। মুক্তিবাহিনীর একটি দল, ঝিনাইদহ মহকুমার এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন এর নেতৃত্ব ১২ জন আনসারের একটা দল, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি এবং নবগঠিত সরকার প্রধান কে গার্ড অব অনার প্রদান করেন (সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে একদল সেনা এই গার্ড অব অনার দেয়ার দায়িত্ব পেলেও অনিবার্য কারণে তারা আসতে পারেননি)। পুরো অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন মেহেরপুর মহকুমা প্রশাসক তৌফিক -ই- ইলাহী, অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন, হুইপ আবদুল মান্নান। প্রচুর সংখ্যক দেশি বিদেশি সাংবাদিক এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন প্রচুর সংখ্যক বাঙালি। আশেপাশের প্রত্যন্ত এলাকার হাজার হাজার মানুষ অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত থেকে মুহুর্মুহু শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত করে রাখেন পুরো এলাকা। “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো – বাংলাদেশ স্বাধীন করো” শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত ছিল সেদিন পুরো মুজিবনগর।

রাস্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে থাকায় উপ রাস্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম কে ভারপ্রাপ্ত রাস্ট্রপতি র দায়িত্ব দেয়া হয়। অধ্যাপক এম ইউসুফ কে রাস্ট্রপতি এবং উপ রাষ্ট্রপতির শপথ করানোর দায়িত্ব দেয়া হয়।।

প্রবাসী সরকারের কুশিলবগণ সবাই ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে ভারতের সহায়তায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ করার প্রয়াস পান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় বাহিনীর সরাসরি তৎপরতায় পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীকে মোকাবেলার কথা বললেও আমাদের প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ সবিনয়ে তাকে বলেন, যুদ্ধ টা আমাদের। আমাদেরই যুদ্ধটা করতে হবে। আপনারা বন্ধুপ্রতিমভাবে আমাদেরকে একটু ট্রেনিং এর জন্য জায়গা আর কিছু অস্ত্রশস্ত্র দিলেই আমরা নিজেরাই আমাদের যুদ্ধটা এগিয়ে নিতে পারবো।

এরপর যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে মিত্রবাহিনী গঠন করে আক্রমণ এর সময়েও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ শর্ত জুড়ে দেন বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেবার। তা না হলে মিত্র বাহিনী গঠিত হবে কিভাবে। মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়মাস জুড়েই মুজিবনগর সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সবাই মিলে এমনি অনেক মনস্তাত্ত্বিক লড়াই, ময়দানের লড়াই, অর্থাভাবের বিরুদ্ধে লড়াই করে, প্রায় এক কোটি শরনার্থী নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে নিতান্তই অপ্রতুল সুযোগ সুবিধা মেনে নিয়ে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের পথ রচনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন।

এই মহান নেতৃবৃন্দকে আজ এই দিনে বিনম্র শ্রদ্ধা ও গভীর ভালোবাসায় স্মরণ করছি।

 

আরও পড়ুন