Ads

ডাক্তারী রঙ্গ

মনসুর আলম
একটি জনপ্রিয় গ্রুপে একজন ডাক্তারের লেখা পড়লাম। “রোগী রঙ্গ” নাম দিয়ে বেশ রসিয়ে কষিয়ে তিনি একটি রঙ্গ লেখার অপচেষ্টা করেছেন। লেখাটি পড়ে এতটাই বিব্রত বোধ করছি যে কোনভাবেই ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না।
ঘটনাটি এরকম:
একজন পয়সাওয়ালা রোগী ভর্তি হয়েছেন দেশের নামকরা একটি হাসপাতালে, অনেক টাকা পয়সার ব্যাপার। রোগীর সাথে ওনার সুন্দরী মেয়ে আছেন দেখভাল করার জন্য। এক পর্যায়ে রোগীর (DRE ডিজিটাল রেক্টাল এক্সামিনেশন) করতে হবে। সোজা কথায় রোগীর পায়খানার রাস্তায় আঙ্গুল ঢুকিয়ে দেখতে হবে প্রস্টেট গ্ল্যান্ড বড় হয়েছে কি না।
তো, মেডিকেল সায়েন্সের বাইরে একজন সাধারণ মানুষের জানার কথা নয় DRE কী? আমাদের দেশের মানুষের তো আরও নয়। আমাদের দেশের কথা আলাদা করে কেন বললাম? কারণ, আমাদের দেশের ডাক্তাররা রোগী এবং তার অভিভাবকদেরকে কোনকিছু ব্যাখ্যা করেন না ফলে বিষয়গুলি আমাদের কাছে পৌঁছায় না।
যা বলছিলাম, মেয়েটি জানতে চেয়েছে রোগীর পায়খানার রাস্তায় আঙ্গুল ঢুকিয়ে ঘুরিয়েছেন কেন? এর জবাবে ডাক্তার কৌতুক করে বলেছেন, “পায়খানার রাস্তায় এক‌টু ম্যাসাজ করে দিলাম।” এবং এই ঘটনা নিয়ে তিনি রঙ্গ লিখেছেন। এই হলো দেশের নামকরা হাসপাতালের নামকরা ডাক্তারের আচরণ। অথচ এখানে কোনধরনের জবাব প্রত্যাশিত ছিলো সেটি একটি উদাহরণ দিয়ে বলি।
গত ১৪ই জুলাই একজন রোগী নিয়ে গিয়েছিলাম কার্ডিওলজিস্টের কাছে। এখানে রোগী চাইলেই স্পেশালিস্টের কাছে যেতে পারে না। আগে একজন জেনারেল ফিজিশিয়ান দেখাতে হয়, তিনি প্রয়োজন মনে করলে স্পেশালিস্টের কাছে পাঠাবেন। জেনারেল ফিজিশিয়ানের রিকুইজিশন ছাড়া স্পেশালিস্টের এপয়েন্টম্যান্ট পাওয়া যায় না।
গত ১৪ই জুলাই একজন রোগী নিয়ে গিয়েছিলাম কার্ডিওলজিস্টের কাছে। এখানে রোগী চাইলেই স্পেশালিস্টের কাছে যেতে পারে না। আগে একজন জেনারেল ফিজিশিয়ান দেখাতে হয়, তিনি প্রয়োজন মনে করলে স্পেশালিস্টের কাছে পাঠাবেন। জেনারেল ফিজিশিয়ানের রিকুইজিশন ছাড়া স্পেশালিস্টের এপয়েন্টম্যান্ট পাওয়া যায় না।
কোভিড পরিস্থিতির কারণে হাসপাতালে মানুষজনের চলাচল খুবই নিয়ন্ত্রিত। বাইরের দিকে যেখানে ডাক্তাররা বসেন সেখানে রোগীর সাথে একজন অভিভাবক যেতে পারবেন কিন্তু, মূল হাসপাতালের ওয়ার্ডের সীমানায় কেবল রোগী ছাড়া আর কেউ যেতে পারবেন না। আমার রোগীর হার্টে ব্লক ধরা পরেছে এবং এনজিওগ্রাম করতে হবে। হাসপাতালে ভর্তির জন্য রোগীর কোভিড টেস্ট বাধ্যতামূলক। রোগীর রেজাল্ট নেগেটিভ আসার পরে ওনাকে ভর্তি করা হয়েছে। যেহেতু কার্ডিয়াক ওয়ার্ড মোবাইল ফোন ব্যবহার করা নিষেধ। সকল রোগীর ফোন দায়িত্বপ্রাপ্ত নার্সের কাছে জমা দিতে হবে। আমার সাথে রোগীর যোগাযোগ বন্ধ। কোভিডের কারণে ওয়ার্ডের ত্রিসীমানায়ও যাবার সুযোগ নেই। এখানে একবার রোগী হাসপাতালে পৌঁছে গেলে আসলে বাইরে থেকে আর কোনো সহযোগিতার প্রয়োজন নেই। যাবতীয় ঔষধ, পরীক্ষানিরীক্ষা, খাবারদাবার সবই ওরা সরবরাহ করবে। এরপরও আমি গেস্ট হাউজে বসে দুঃশ্চিন্তা করছিলাম রোগীর অবস্থা নিয়ে।
কিছুক্ষণ পরেই ডাক্তারের অফিস থেকে ফোন আসলো- ডাক্তার আপনার সাথে কথা বলবেন, আপনি কি একটু আসতে পারবেন?
আমি তড়িঘড়ি করে দৌড়ে গেলাম। ডাক্তার আমাকে ভেতরে ওনার অফিসে নিয়ে গেলেন। তিনি এমন একজন কার্ডিওলজিস্ট ২/৩ মাস আগে যোগাযোগ না করলে এপয়েন্টম্যান্ট পাওয়া যায় না। তিনি আমার পিঠে হাত দিয়ে বসালেন, চেয়ার টেনে আমার পাশে এমনভাবে বসলেন যেনো দুই বন্ধু দীর্ঘদিন পরে দেখা হয়েছে। রোগীর পুরো ফাইল, সবধরনের ডায়াগনোসিস, এক্সরে ফিল্ম সবকিছু টেবিলে মেলে ধরে শুরু করলেন:
– আমরা রোগীকে সব ব্যাখ্যা করেছি। তারপরও অভিভাবক হিসেবে আপনাকেও জানাতে চাই।
প্রথমে দেখালেন কোথায় ব্লক হয়েছে, কত শতাংশ ব্লক হয়েছে? তারপর ব্যাখ্যা করলেন কীভাবে এনজিওগ্রাম করবেন? প্রয়োজন হলে Stene বসাবেন। স্টেন কী, কীভাবে কাজ করে, সাইজ কত?
একেবারে স্টেন আমার হাতে দিয়ে বললেন, “এই জিনিস বসানো হবে।” কাগজে পেন্সিল দিয়ে ডায়াগ্রাম এঁকে ব্যাখ্যা করলেন পুরো প্রণালী। তারপর বললেন কতদিন রেস্টে রাখতে হবে আরও যত পরামর্শ দেয়া যায় সব বলে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি সন্তুষ্ট? আমরা কি প্রসেস শুরু করবো?”
এই হলো রোগী এবং অভিভাবকদের সাথে ডাক্তারদের আচরণ। তারপরও প্রতিদিন সকালে আমাকে ফোন করে বিস্তারিত জানানো হতো রোগীর অবস্থা এবং কী কী সেবা দেয়া হচ্ছে?
আমাদের জনবল কম, ডাক্তারদের হাতে এত সময় নেই। পরিস্থিতি আমরা বুঝি, এতটা প্রত্যাশাও করি না। তাই বলে রোগীর ছেলেমেয়ে অবস্থা জানতে চেয়ে প্রশ্ন করলে রঙ্গ করবেন? আমরা কি এতটাই মূর্খ যে অসুস্থ পিতামাতার কী চিকিৎসা হচ্ছে সেটি জানার অধিকার রাখিনা?
মনসুর আলম
সাউথ আফ্রিকা।
প্রবাসী,লেখক,সাহিত্যিক ও সহ-সম্পাদক,মহীয়সী।
আরও পড়ুন