Ads

ভ্রমণ কাহিনী

পর্ব — ০৮

– নুরে আলম মুকতা

জান্নাতুল মুয়াল্লা ! মুয়াল্লা আরবী শব্দের অর্থ উঁচু। মসজিদুল হারামের যেদিক উঁচু সেই পাশে এ কবরস্থানটি। হেরেম শরীফের উত্তরে মারওয়া গেট থেকে এর দুরত্ব মাত্র এক কিলোমিটার। চারপাশ সুরক্ষিত। কোন চিহ্ন নেই। মহিলারা প্রাচীরের বাইরে থেকে দেখে থাকেন। ১৯২৫ খৃষ্টাব্দের পর চিহ্নগুলো সৌদি রাজ ধ্বংশ করে দিয়েছে । এখানে মা খাদিজা (রাঃ) বিনতে খুওয়াইলিদ, মুহাম্মাদ (সাঃ) এর দাদা আব্দুল মুত্তালিব (রাঃ) চাচা আবু তালিব সহ অনেক বিখ্যাত মুসলিম সাহাবায়ে কেরাম শুয়ে আছেন। কোন চিহ্ন নেই। কোন কবরই বাঁধা নেই। হযরত মুহম্মদ সাঃ মদিনায় হিজরত করার আগে অনেক বিখ্যাত মুসলিম আর সাহাবায়ে কেরামদের এখানে সমাহিত করা হয়েছিলো। একজন অভিজ্ঞ হাজী যিনি কয়েকবার হজ্বে এসেছেন। তিনি বললেন, আমার পেছন পেছন আসুন। যে কবরের পাশে দেখবেন পুলিশের সতর্ক দৃষ্টি আর অবস্থান,ধরে নেবেন বিখ্যাত কারো কবর। পুলিশ কোন কবরের পাশে দাঁড়াতে দেবে না। জিয়ারত করতে হবে হাঁটতে হাঁটতে আর দোয়া করতে হবে নির্দিষ্ট স্থানে,যেখানে কোন কবর নেই। একটি কবরের কাছে দাঁড়ালাম। বড় টিনের প্লেন সীট দিয়ে ঢাকা। হাতল লাগানো আছে। মুহূর্তেই টেনে সরালাম সীট। বেশ গভীর, লম্বা লোহার সিড়ি নামানো আছে। দ্রুত ঢেকে ফেললাম। নীচে বিশাল ঢালাই করা ঘরের মতো গর্ত। ওখানে একসাথে অনেক লাশ নামানো যায়। পুলিশ দেখতে পায়নি,দেখলে আমাকে বলে দিত….খালাশ,বেরিয়ে যাও এখান থেকে। কবরস্থান টিতে মৃত হাজীদের স্থান দেয়া হতো। এখন জায়গা নেই বললেই চলে। মক্কায় যাদের চিরতরে থাকার সৌভাগ্য হয় তাদের শহর থেকে একটু দূরে সমাহিত করা হয়।
ব্যাতিক্রম ক্ষেত্রে ঐ যে আন্ডারগ্রাউন্ড গ্রেভ আমি দেখলাম সেগুলো ব্যবহৃত হয়।
পাশেই ঐতিহাসিক জ্বীন মসজিদ। এত মানুষ বাইরে কিন্তু ভেতরে মাত্র জনাদশেক। এত মানুষ গেল কোথায়? আমি আর আপা ঠোটে তর্জনী ঠেকিয়ে চুপ করার সঙ্কেত বিনিময় করলাম। বেশ স্পেস। চারপাশ সবুজ গালিচা দিয়ে মোড়া। এখানে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) কাছে জ্বীনরা প্রথম ইসলাম গ্রহন করেছিলেন। সুবহানাল্লাহ! শান্ত,স্থির, মনোরম, নিরিবিলি। আপা আর আমি পরম মমতায় আল্লাহর শানে সেজদাহ করলাম। পরম প্রশান্তি। সৌভাগ্য বশত মসজিদের ইমামকে পেয়ে গেলাম। সংক্ষিপ্ত আলাপ হলো। এখানে এলে মুসলমান জ্বীন সম্পর্কে ইনশানের ধারনা পাল্টে যাবে। মক্কা আর মদিনায় অতি জাগতীক অনেক বিষয় মানুষের অনুসন্ধিৎসু মনের কপাট খুলে দিতে পারে। মক্কা অবস্থানের সময় ফুরিয়ে আসছে। কাজ করে মন ভরে না। কোথায় যেন একটা অতৃপ্তি থেকেই যাচ্ছে। কাবা বায়তুল্লাহ প্রাঙ্গন থেকে
আজ আর ফিরে আসবো না, চলেন আপা। সকালে গিয়ে সারা দিনরাত আপনাকে নিয়ে ওখানেই কাটাবো। আপার এখন আর ক্লান্তি নেই। আমি যখনই বলতাম যাই, আপা তখনই প্রস্তুত। বিষয়টি ভোলার নয়। বুকের মধ্যে কাঁপন ধরে যায়! মক্কায় অবস্থানের সময় আমরা ভাইবোন প্রায়ই এ কাজ করতাম। পরম শান্তি। এ শান্তি আর কখনও কোথাও মিলবে না।

একদিন কাউকে না জানিয়ে হাতের বেল্ট, গলায় ঝুলানো কার্ড, কাঁধে হাল্কা ব্যাগ, একবোতল জমজম পানি নিয়ে একা আমাদের বাসার পাশের আল হিজরাহ রোড ধরে হেঁটেই চলেছি। বুকের মধ্যে একটাই বাসনা নিয়ে যে, মহানবী (সাঃ) এ রাস্তা দিয়েই প্রিয় জন্মভুমি ত্যাগ করেছিলেন। আমার ইচ্ছে হারিয়ে যাই। বাদ মাগরিব। রাস্তা আর উঁচু উঁচু ভবনের আলো কমে এলো। মনে হচ্ছে মরুভুমির দিকে চলে যাচ্ছি। খেজুর গাছের ছায়া দেখা যাচ্ছে, সামনে আর এগোতে পারছি না। আমি ধারনা করছি যে পথ দিয়ে এসেছিলাম সেই পথে আমি আর নেই। লেন হারিয়ে ফেলেছি। দুরে একটি দোকানের আলো দেখা যাচ্ছে। ও আলো দেখে চলতে শুরু করলাম। এশার ওয়াক্ত হয়ে গিয়েছে। আমি পরম সৌভাগ্যবান! দোকানটি একজন দেশি ভায়ের। তিনি বাংলা কথা বলতেই স্বস্তি পেলাম। আপনি তো প্রায় হযরত আয়েশা (রাঃ) মসজিদ পর্যন্ত চলে এসেছেন। ওমরা করেছেন? আমরা এর আগে গাড়িতে এসেছি ইহরাম বাঁধার জন্য। এজন্য রাস্তা চিনি না, আমি বললাম। এজন্য রাস্তা ভুল করছেন। আগে বসেন,রেস্ট করেন,পানি নেন,খেজুর নেন। আমি আবেগে আপ্লুত হলাম। দেশী ভাই ওর সৌদী নম্বর দিয়ে বললেন , আমি আপনাকে আলমানসীর রোড ধরিয়ে দিচ্ছি। যে কোন সমস্যায় ফোন দিবেন। মায়ের টান , নাড়ির টান, মাতৃভাষার টান! ভোলার নয়।

একদিন আসরের ওয়াক্তে ভাইবোন বেরিয়ে গেলাম। মনের আনন্দে বায়তুল্লাহ র দিকে হাঁটছি। আমাদের রাস্তাটিতে গাড়ীর দাপট কম। তাই হাঁটা সহজ। ফুটপাথ আফ্রিকান নারীদের দখলে। পুলিশ আসলে মূহুর্তেই ফাঁকা। রাস্তার পাশেই ভাইবোন আসর পড়তে বাধ্য হলাম এক জননীর কারনে।
অতীব সুন্দরী এক মহিলা! বয়স ঠাহর করা মুশকিল! আপাতদৃষ্টিতে বিগত যৌবনা নয়। দুটো ফুটফুটে শিশু নিয়ে কি বলছে বুঝতে পারছি না। আমি একা হলে এড়িয়ে যেতাম। কিন্তু আপার জন্য ওর কাছে যেতে হলো। ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করছেন আপা, কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। ভাষা, মিশরীয় আঞ্চলিক। ইশারা আর ইঙ্গিতে কতোটুকুই বা আর হয় ! ও সদ্য স্বামী হারা, যিনি ছিলেন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা।
বাধ্য হয়ে পা বাড়িয়েছেন অজানার উদ্দেশ্যে। আপা আর ঐ নারীর চোখে অশ্রু। আমার স্মৃতিতে মিশরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। ও ক্ষুধার জন্য রাস্তায় খেলনা বিক্রি করছে। ওর আর শিশু দুটোর পোশাক উন্নত । ওর কাছ থেকে আমি দুটো খেলনা বল কিনতে চাইলাম। আপার নির্দেশে আটটিই কিনতে হলো। ও তো ভিক্ষুক না, এজন্য ওর সব খেলনা কিনে ওকে সাহায্য করি,আপার নির্দেশ আমার শিরোধার্য। ছবি তুলতে চাইলে ও হাত জোড় করে ক্ষমা চাইলো। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে কাবার পানে হাঁটতে শুরু করলাম।

বাধ্য হয়ে পা বাড়িয়েছেন অজানার উদ্দেশ্যে। আপা আর ঐ নারীর চোখে অশ্রু। আমার স্মৃতিতে মিশরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। ও ক্ষুধার জন্য রাস্তায় খেলনা বিক্রি করছে। ওর আর শিশু দুটোর পোশাক উন্নত । ওর কাছ থেকে আমি দুটো খেলনা বল কিনতে চাইলাম। আপার নির্দেশে আটটিই কিনতে হলো। ও তো ভিক্ষুক না, এজন্য ওর সব খেলনা কিনে ওকে সাহায্য করি,আপার নির্দেশ আমার শিরোধার্য। ছবি তুলতে চাইলে ও হাত জোড় করে ক্ষমা চাইলো। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে কাবার পানে হাঁটতে শুরু করলাম।

বার বার দেখেও তৃষ্ণা মেটেনা। অদ্ভুত এর আবেদন! মায়াজাল, এ মায়া সারা বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। কোটি কোটি হাজার কোটি আদম সন্তানের জন্য এক অদম্য সৃষ্টি। সারা বিশ্বের সর্বকালের সেরা এ সভ্যতা। সমস্ত সভ্যতা এখানে এসে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। আল্লাহর ঘর ! এখানে এলে আর কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে চিরতরে পূরন হয়ে যাবে। হৃদয় প্রশ্বস্ত হবে ,অন্তর খুলে যাবে, কালিমা মুক্ত হবে দেহ আর মন। এর স্পর্শে যাদু আছে । এ যাদু, মহাশ্রষ্টার মায়ার যাদু। কাউকে জোর-জবরদস্তি করে এখানে আনা হয় না। কারো ওপর কোন কিছু চাপিয়ে দেয়া হয়না। মানুষ আনন্দচিত্তে করে। শান্তিপূর্ণ ভাবে করে। কেউ কাউকে আঘাত করে না। রাগ,অনুরাগ,বিরাগ এখানে নেই। এখানে আছে পবিত্র প্রতিযোগিতা। আছে মহাবিশ্বের সুন্দরের সুন্দরতম আলিঙ্গন। হিংসাও যে সুন্দর হয় তা এখানে এলে বোঝা যায়।

বার বার দেখেও তৃষ্ণা মেটেনা। অদ্ভুত এর আবেদন! মায়াজাল, এ মায়া সারা বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। কোটি কোটি হাজার কোটি আদম সন্তানের জন্য এক অদম্য সৃষ্টি। সারা বিশ্বের সর্বকালের সেরা এ সভ্যতা। সমস্ত সভ্যতা এখানে এসে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। আল্লাহর ঘর ! এখানে এলে আর কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে চিরতরে পূরন হয়ে যাবে। হৃদয় প্রশ্বস্ত হবে ,অন্তর খুলে যাবে, কালিমা মুক্ত হবে দেহ আর মন। এর স্পর্শে যাদু আছে । এ যাদু, মহাশ্রষ্টার মায়ার যাদু। কাউকে জোর-জবরদস্তি করে এখানে আনা হয় না। কারো ওপর কোন কিছু চাপিয়ে দেয়া হয়না। মানুষ আনন্দচিত্তে করে। শান্তিপূর্ণ ভাবে করে। কেউ কাউকে আঘাত করে না। রাগ,অনুরাগ,বিরাগ এখানে নেই। এখানে আছে পবিত্র প্রতিযোগিতা। আছে মহাবিশ্বের সুন্দরের সুন্দরতম আলিঙ্গন। হিংসাও যে সুন্দর হয় তা এখানে এলে বোঝা যায়।

কে কার আগে কাছে যেতে পারবে সেজন্য লক্ষ লক্ষ মানব নিয়ত সুশৃঙ্খল প্রতিযোগিতা করেই চলেছে। কেউ কাউকে আঘাত বা কষ্ট দেয়না। এখানে কোন ভেদ নেই। লিঙ্গের কোন পার্থক্য নেই। কেউ ভাবেনা। কোন এক মায়াজালে মন থেকে সমস্ত নিষিদ্ধ উধাও হয়ে যায়। আজ আল্লাহর ঘর আপাকে স্পর্শ করাব বলে ভাইবোন প্রতিজ্ঞ হয়েছি। দু বার তাওয়াফ করেও হলোনা। ছিটকে বাইরে বেরিয়ে আসছি। যত কাছাকাছি যাচ্ছি নিশ্বাস বন্দ হয়ে আসছে। দীর্ঘকায় আফ্রিকানদের মাঝে পড়ে এ অবস্থা হচ্ছে বার বার। বিস্ময়কর ভাবে হতাশা গ্রাস করছে না। যতবার ছিটকে যাচ্ছি ততবার ভাইবোন হাসছি। ওয়াশ রুমের দরকার হলো আপার। হেরেমের বাইরে আন্ডার গ্রাউন্ড ওয়াশরুম। আমি ওপরে দু রাকাআত নামাজ পড়ে নিই, তাই ভাবলাম। কিছুক্ষণ পরে দেখি পুলিশ ব্যারিকেড দিচ্ছে। দিক। ওরা তো প্রায়ই এগুলো দেয়। কিন্তু না। এবার আমাকেও সরে যেতে বলছে।
হাজ্জা হাররেক…..
হাজ্জা হাজ্জা…. তারেক….হাজ্জা বলতেই আছে। ওদের সবার হাতে ওয়াকি টকি আর ওদের দৃষ্টি আকর্ষন করার অস্ত্র হাততালি । এভাবেই ওরা লক্ষ মানুষ নিয়ন্ত্রণ করছে। কখনও কোন হাজীর শরীর স্পর্শ করে না। একবার বাঁধা দিলে ও পথ মাড়ানোর আর জো কারো নেই। নিরুপায় হয়ে আপাকে উদ্ধারের জন্য নীচে নামতে উদ্যত হলাম। নারী শৌচাগার জেনেও। আমার পিছু নিয়েছে পুলিশ। ততক্ষণে আমি আপার হাত ধরে ফেলেছি। রিস্ক আমাকে নিতেই হবে। আমি আমার প্রানপ্রিয় আপাকে হারাতে চাইনা। দোতালায় চলে গেলাম। হেরেমে বিস্তর জায়গা। লম্বা হয়ে শুয়ে বিশ্রাম নিয়ে তারপর আবারো নীচে নামবো। আমরা মাগরিব আর এশা পেরিয়ে গিয়েছি।

(চলমান)

আগের পর্ব-ভ্রমণ কাহিনীঃ লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক (পর্ব-০৭)

লেখকঃ সাহিত্যিক,শিক্ষক ও সহ-সম্পাদক,মহিয়সী।

 

আরও পড়ুন