Ads

ভ্রমণ কাহিনী 

লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক
ভ্রমণ কাহিনী
— নুরে আলম মুকতা
জাবালে হিরা বা জাবালে নূর। বিস্ময়কর এক পাহাড়। মক্কা মদীনা দেখলে আর কোন দর্শনীয় স্থান ভ্রমণের তৃষ্ণা আপনার মিটে যাবে। হেরা পর্বত ছুয়ে নিলে আর কোন পর্বত স্পর্শ করার ইচ্ছে আপনার জাগবে না।
পাহাড়টি অন্য গুলোর মতো কালো পাথরের নয়। উচ্চতা প্রায়  দুই হাজার একশো ফুট। ওঠা নামা সবার দ্বারা সম্ভব নয়। ওখানে ওঠার বিষয়ে বোর্ডে  লিখে সতর্ক করা হয়েছ। উঠতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে তা সত্বেও অনেকে উঠে যাচ্ছে। এখনও এত দূর্গম তো ১৫০০ বছর আগে কি নির্জন আর দূর্গম ছিলো। ওঠা কষ্টকর নিঃসন্দেহে। একজন সামর্থ্যবান মানুষের কমপক্ষে একঘন্টা লাগবে। কোথাও কোথাও পাহাড় কেটে সামান্য পথ আর রেলিং বসানো হয়েছে কিন্তু পাহাড় অক্ষত রাখার স্বার্থে ব্যাপক করা হয়নি।  আমি শুধু আশ্চর্য নেত্রে দেখেছি সারা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ , সুন্দরী,সম্পদশালী  নারী মা হযরত খাদিজাতুল কুবরা (রাঃ) এই পাহাড়ে উঠে প্রিয়নবী কে খাদ্য পৌঁছে  দিয়েছেন! প্রস্তরাকীর্ন পথ, বিরুদ্ধ আবহাওয়া আর আঁধার তো ছিলোই। মহীয়সী র ত্যাগ সারা বিশ্বের সৃষ্টির জন্য ! এখন পাহাড়টির চারিদিকে আবাসিক  ভবন বেষ্টন করে ফেলছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যেখানে ধ্যানে মগ্ন থাকতেন ও গুহাটি খুবই ছোট স্পেশ। তবুও আবেগপ্রবণ মানুষ ওখানে প্রবেশ করছে। ওরা বুঝতে চায়না যে আল্লাহর তরফ থেকে বিশেষ ভাবে প্রস্তুত কৃত এবং নির্ধারিত মানুষটির জন্যেই এটি তৈরি। একদম ছোট স্পেশ। ওখানে এবাদতের আলাদা মর্তবা নেই একথা বলার পরও আবেগ প্রবণ মানুষ নামাজ পড়ছে। পাহাড়ের পদতলে দাঁড়িয়ে উপভোগ করাই উত্তম। আমার খেলোয়াড়ী শরীরের যৌবন উদ্দীপ্ত তাগদ দিয়েও চারবার বিশ্রাম নিতে হয়েছে। আমি বার বার অবাক বিস্ময়ে ভেবে নিশ্চিত হয়েছি আল্লাহর বিশেষ ইচ্ছা না থাকলে এখানে উঠা নামা সম্ভব নয়।
হেরা গুহা, যেখানে মহানবী ধ্যানে মগ্ন থাকতেন
আমাদের বাড়িটির রোডের  নাম আল হিজরাহ রোড।  মুল রাজপথ ইব্রাহিম খলিলের পাশে এটি দুই লেনের। ওখানে মুল রাজপথ সব চার লেনের।  এই রাস্তা দিয়েই মহানবী ( সাঃ) কাঁদতে কাঁদতে প্রিয় সহচর আবু বকর ( রাঃ) নিয়ে মদিনায় হিজরত করেছিলেন। এজন্য  আমার গারে সাওয়ার পর্বত  দেখার বাসনা। ধূ ধূ  প্রান্তর। এখানে লোকজনের ভীড় কম।  ইমারত তৈরী হয়নি। ছোট্ট আয়েশা আর খাদিজা র প্রশংসা করে শেষ করা যাবেনা। কেমন কষ্ট স্বীকার করে এখানে  মহানবী( সাঃ) কে বেঁচে থাকার রসদ পৌঁছে দিতেন!
আপা হাত ধরে ফেলল। এখানে আর উঠিস না ভাই। পানির জন্যে মারা যাবি। সূর্যের তেজ আর থামা যাচ্ছে না। এত প্রবল  যে শরীরে কোন ঘাম নেই। গলা শুকিয়ে কাঠ। বোতলের পানিও শেষ। ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। শত্রুদের হাত থেকে বাঁচার জন্য বন্ধুকে নিয়ে মহানবী (সাঃ) লুকিয়ে ছিলেন তাই পাহাড়টি দূর্গম আর রাস্তা থেকে বিচ্ছিন্ন।
রাস্তায় কিছু কিছু স্থানে খেজুর গাছ চোখে পড়েছে। কিন্তু এগুলো রুক্ষ,সতেজ মনে হয়নি। মক্কা শহরে গাছ-পালা নেই বললেই চলে। নিম গাছ ছাড়া আফ্রিকান একটি পাতা বহুল গাছ চোখে পড়ছে কিন্তু সংখ্যায় খুব কম । কবুতর চত্বর আর কিছু স্থানে ঘাস লাগানোর প্রানান্তকর চেষ্টা দেখেছি। এক দেশী প্রবাসী ভাই বলেছিল, ইয়েমেনের সাথে সৌদীর যুদ্ধে জড়িয়ে যাবার পর থেকে এগুলোতে পানির সরবরাহ   একদম কমে গেছে। আগে নিয়মিত পানি দেয়ার জন্য  এগুলো সতেজ ছিলো।
আমরা আসলেই সোনার দেশের মানুষ।
বায়তুল্লাহ আসা-যাওয়ার প্রবেশ মুখে রাস্তায় প্রায় দিনই নজরে পড়ত বিশাল এক লরি দাঁড়িয়ে। পাশে দীর্ঘ লাইন। বেশির ভাগ মানুষ আফ্রিকান । ওদের সাথে পাল্লা দিয়ে কোন কাজ করা সম্ভব না। আমরা নৃ-তাত্বিকভাবে  ভাবে খর্বকায়। একদিন পাশে দাঁড়ালাম। এক বিশালদেহী  আমাকে সুন্দর ভাবে জায়গা করে দিল । ভাবটি এমন যে,বাপু  দাঁড়াও আমি আছি তোমার কোন সমস্যা হবে না। মাত্র দুমিনিটের মধ্যে সৌদি রাজের দেয়া প্যাকেট হাতে নিলাম। খুলে দেখি চিকেন ফ্রাই আর ফ্রায়েড রাইশ । পৃথিবীর সেরা আর মুল্যবান ওলিভ ওয়েল দিয়ে রান্না। আমাদের চলবে না। ঘ্রান টাই অন্যরকম। যার সাথে আমরা কোনভাবেই অভ্যস্ত না।
মক্কা থেকে মদীনা হিজরতের সময় মহানবী (সাঃ)যে পাহাড়ে লুকিয়ে ছিলেন। জাবালে সাওর।
যোহর আর মাগরিবের পর কমপক্ষে পাঁচটি গেটে এভাবে পর্যাপ্ত খাদ্য বিতরন করে ওরা।কিন্তু বাংলাদেশীরা নিতে পারেনা,খেতেও পারেনা। তবে খানাটি পিওর।
আমাদের  কাফেলার বাবুর্চি  ভালো রান্না করে। সরবরাহ  চমৎকার। খানার বিষয়ে আমাদের কখনও বিড়ম্বনা  হয়নি।
কারো যদি সমস্যা হয় তবে বাইরে ইচ্ছে মতো খেতে পারেন। আমি আর আপা জুস,জমজম পানি আর খেজুর ভক্ষণ করে কাটিয়ে দিয়েছি দিনের পর দিন। আমাদের বাড়ীটি হজ্বের মৌসুমে  সৌদি সরকারের তালিকাভুক্ত এজন্য বড় ড্রামে করে জমজম পানি পানের জন্য সরবরাহ ছিলো।
রাস্তায় বেরুলে অনেক মানুষ আর সংস্থা বিভিন্ন রকম খানা হাতে ধরিয়ে দেয় কিন্তু ওগুলোতে আমরা অভ্যস্ত নই। চকলেট গুলো এনার্জেটিক  কিন্তু মুখে দিলে মনে হয় গলা দিয়ে উঠে আসবে। জ্বী গুলিয়ে আসে। জুস আর পানি টা রেখে আমি আফ্রিকান ভাইবোন দের দিয়ে দিতাম।
একদিন আপাকে বায়তুল্লাহ তে  বসিয়ে আমি ওয়াশরুম গিয়েছি। এসে দেখি আপার সামনে চারটি কলা আর একটি পাউরুটি  রাখা। আপা বাইতুল্লাহর দিকে মুখ করে সেজদায়। আমি চুপ করে বসে গেলাম। পাশে একজন সুদর্শন  মিশরীয় যুবক ক্লীন সেভড কাবার দিকে তাকিয়ে অনর্গল মুখস্ত পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করেই যাচ্ছেন আর দুচোখে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।  ও কায়রো ভার্সিটির সিনিয়র ছাত্র। হোসনী মোবারককে নিয়ে তখন মিশর টালমাটাল । চোস্ত ইংরেজি বলে। আপা উঠে বসলে কলাগুলো সামনে দিলাম। অবাক! এত বড় কলা! আমরা বিস্মিত। কোন দেশের,কে দিল জানিনা। রুমে এসে সবাইকে দেখালাম। ভাগ করে তৃপ্ত হলাম।
মাত্র পাঁচ রিয়ালে এক কেজি ফ্রেশ আঙ্গুর। স্বাদও চমৎকার। টকের ট ও নেই। এক লিটার কমলা জুস পাঁচ রিয়াল। তবে আর অসুবিধা নাই। প্রায় সব ফলেরই জুস পাওয়া যায়। আপা আপেলের  জুস একদম মুখে দিতে পারত না। পাস্তুরিত  দুধ একদম সস্তা। সরাসরি  অথবা গরম করে খাওয়া যায়।
আমাদের সকাল বিকাল ভাইবোনের চা না হলে চলে না।এজন্য আমরা পর্যাপ্ত টি ব্যাগ,চিনি আর হিটার জগ নিয়ে গিয়েছিলাম। আসলে দরকার ছিল না। ওখানে সবই কিনতে  পারতাম। না জানা থাকলে যা হয়। ঘরকুনো বাঙ্গালী আমরা বেঁধে নিয়ে যাই আবার মাথায় করে নিয়ে আসি!
বাইরে এক কাপ রেড টি দুই রিয়াল। যখন হিসাব করি চুয়াল্লিশ  টাকা,মাথা নষ্ট।
ফল-মুল,শস্য এগুলোতে ওদের সরকারের প্রচুর ভর্তুকি আছে এজন্য সুলভ।
মাগরিবের নামাজ পড়ে  কাবা থেকে ফেরার পথে আলমানসী হোটেলের নীচে অপরুপ দুটো শিশু,ভাই-বোন বিশাল চায়ের ফ্লাস্ক নিয়ে রোজ দাঁড়িয়ে দেখতাম। কথা বলার ইচ্ছে  হলো। ওদের কাছে যাওয়া মাত্র,
হাজ্জা তী?
আরবীয় রা ট এর উচ্চারন ত করে। ওকে, আমি বললাম।  ঢাউস সাইজের একটি পাউরুটি আর প্রমান সাইজের একটি গ্লাসে ভরে দুধ চা দিয়ে দুজনই আনন্দের  হাসি হাসে। আমিও হাসি।  মক্কার রাজপথে বসে সুদূর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে চা  এ চুমুক দিলাম। অদ্ভুত স্বাদ! মায়ের তৈরী, সওয়াবের আশায় হাজীদের জন্য উৎসর্গ। ওরা মিশরীয় বংশোদ্ভূত মক্কার স্থায়ী বাসিন্দা। আমাদের পাশেই  বাড়ি। ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ে। শিশুদের সাথে মনের ভাব বিনিময় করে আমি আনন্দিত। ওরা আমাকে বন্ধু হিসেবে নিয়েছে মনে হলো। মক্কা ত্যাগ করার পর আপা আর আমি ওদের কথা মনে করে হৃদয়ের  ভার বাড়িয়েছি।
আগামীকাল জান্নাতুল মোয়াল্লা আর জ্বীন মসজিদ যাবার কথা আছে।
আমি সম্ভবত মা খাদীজার কবরের পাশে। শরীর কম্পমান!
মা খাদীজাতুল কুবরা ( রাঃ) ! বিস্ময় কর এক মহীয়ষী নারী! সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী। সুন্দরী আর সম্পদশালী। প্রেম ভালোবাসা আর ত্যাগের মহিমায়  ভাস্বর।  ঐশী জৌতিতে কম্পমান মুহাম্মদ (সাঃ) কে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। প্রথম কলেমায়ে তৈয়বা আর শাহদৎ পাঠ করেছেন। বিশ্বের প্রথম ইসলামের সুবিশাল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণকারী বিশ্বাসী মানুষ! তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। সুবহানাল্লাহি অবি হামদিহি।  আমরা জান্নাতুল মোয়াল্লায় যখন,তীব্র তাপদাহ বইছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। কবরস্থানটি মক্কা মুল শহরের মধ্যে পড়ে গিয়েছে। হেরেম শরীফের একদম নিকটে।হেঁটে যেতে হবে। মক্কার গুরুত্বপূর্ণ  স্থাপনাগুলো পাশাপাশি প্রায়। প্রাচীনকালে নগরীর বিস্তৃতি কেমন ছিলো তা দেখলে কল্পনা করা যায়। আমরা বিভিন্ন ইতিহাসে জেনেছি বিশ্ব সৃষ্টির প্রারম্ভে মহাসাগরের পেট ফুড়ে পৃথিবীর কেন্দ্রে যে বিস্ময়কর মাটি সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ তা পবিত্র কাবা বায়তুল্লাহর ভিত্তি।
(চলবে)
নুরে আলম মুকতা ,
কবি,সাহিত্যিক,অনুবাদক ও সহ-সম্পাদক,মহীয়সী।
আরও পড়ুন