Ads

আহা জীবন

রত্নার বাসায় চুরি হয়েছে । কী ভয়াবহ চুরি ! বাসার প্রায় সব , এমন কি হাড়ি-পাতিল যতোটা পারে চোর সাফ করে নিয়েছে ।

চেনা মানুষ ছাড়া এমন চুরি সম্ভব ! ওর বরটাও মনে হচ্ছে চুরি হয়ে গেছে ।

চোরটা কি বরটাকেও চুরি করে নিল! চারদিকে হৈ চৈ ,রত্নার হাহাকার কিন্তু লোকটার কোন খবর নেই।

চার বছর মহিলা শ্রমিক হিসেবে সুদূর ওমানে থেকে এসেছে রত্না ; এই তো মাস খানেক হলো সে দেশে এসেছে সেই ওমান মুলুক থেকে। বাড়িতে রেখে গেছিল তার ছোট ছোট দুটো বাচ্চা আর স্বামীকে। চার বছরের মাঝে একবার মাত্র সে
দেশে এসেছিল। আসার সুযোগ পেয়েছিল বলাই ভালো। চাকরি শেষে দেশে ফেরার এক মাসের মধ্যেই চার বছরের অক্লান্ত শ্রম আর সীমাহীন ত্যাগের ফসল একরাতের চুরিতেই শেষ!

চার বছরে যা আয় করেছিল সবটাই পাঠিয়েছিল বাড়িতে, ওর স্বামীর কাছে । আসার সময় এক রতি সোনাও সে কেনেনি ; তার বা তার কিশোরী মেয়েটির জন্য। সবটাই সে সংসারে পাঠিয়েছিল। তারপরে এই সর্বনাশ। সর্বস্ব হারিয়ে রত্না আমার বন্ধুর বাসার কার্য সহকারী।

ঈদের দাওয়াত পেয়ে আমার বন্ধু রিনার বাসায় গিয়ে রত্নার সাথে পরিচয় হলো । সে রিনার বাসার হোম মেকার ; কর্মঠ, দক্ষ চল্লিশ বছরের রত্না। নানা রকম আয়োজনের পরিবেশনে ছুটে ছুটে রিনাকে সাহায্য করছে হাসি মুখে।

রাজধানী ঢাকার মতো কসমোপলিটন শহরে প্রতিটি পরিবার একান্ত একা। এখানে কেউ কারও নয়। সবই ভীষণ ব্যস্ত। কারো দিকে ফিরে তাকানোর সময় সুযোগ কারও নেই। তাই চাকরিজীবী মায়েরা একান্ত ভাবে কার্যসহকারীদের উপর নির্ভরশীল। তাদের সন্তানদের একা বাসায় রেখে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে এখন তারাই ভরসা। তাদের সহযোগিতা ছাড়া একটা দিনও কাটানো কঠিন।

রিনার বাসায় রত্নাকে দেখে ওর কাজ কর্ম দেখে মেয়েটাকে খুব ভালো লাগল । রিনার বাচ্চাদুটোকে গোসল করানো ,খাওয়ানো সব নিপুনভাবে করছে রত্না। খুব বুদ্ধিমতি আর দক্ষ মনে হলো ওকে আমার।

অনেকদিন ধরে আমার বাসায় সহকারী নেই। একজন ছিল ,তাকে আমার মায়ের সেবার জন্য পাঠিয়ে আমি হাবুডুবু খাচ্ছি। কর্মসংস্থান বাড়ায় এখন সহকারী পাওয়া ভীষণ কঠিন হয়ে গেছে । তাছাড়া-

‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচাতে চায়!’

আমার ক্ষেত্রে বিষয়টা আরও কঠিন।হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক পাওয়া কঠিন যেমন তেমনি মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ এখন হিন্দু বাড়িতে কাজ করতে নারাজ। আমার যদিও কোনো সমস্যা নেই
আগেও আমার বাসায় কুলসুম ,সাবিনা কাজ করে গেছে। তাই তো যাকে পাই তার কাছেই লোক চাই।

করোনাকালে আমি অফিস যাচ্ছি না তাই কোনও রকম দিন চলছে। কিন্তু অন্যান্য কাজ বড় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ,বিশেষত লেখালিখি। সময় নষ্ট হচ্ছে প্রচুর । জীবন থেকে সময় যেন বিদ্যুৎ গতিতে চলে যাচ্ছে। কিন্তু কোনো ভাবে লোকের খোঁজে মিলছে না। যাকে পাচ্ছি তাকেই বলছি। একই ভাবে রত্নাকেও বললাম আমার জন্য একটা লোক দেবার কথা। লোক চেয়ে বাস্তব সমস্যার কথা মাথায় রেখে ওকে বললাম

–রত্না আমার বাসার জন্য তোমার মতো একটা মানুষ দাও না , যার উপর নির্ভর করে নিশ্চিন্তে অফিস করতে পারি। তবে তুমি জানা তো ,আমি যে হিন্দু।

আমাকে অবাক করে দিয়ে রত্না বলল

–তাতে কী হয়েছে ? আপনিও মানুষ,আমিও তো তাই,হিন্দু তাতে সমস্যা কী?

একটা কথাতেই আমার মনে হলো-
রত্না সত্যিকারের ‘রত্ন’।

আমি বিস্মিত হলাম রত্নার রত্নময় কথায় । হতচোকিত হলাম, চমৎকৃত হলাম। যেখানে হাজার হাজার হিন্দু-মুসলিম আছে যারা একে অপরে হিন্দু-মুসলিমদের বাড়িতে এখন ভাত খেতে প্রবল আপত্তি করে। তারা কিন্থু দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে উচ্চতর ডিগ্রিধারীও বটেন !

এখন মুসলিম ছুটা বুয়াও হিন্দুবাসায় কাজ নিতে চায় না,কাজ নিলেও খেতে চায় না। হিন্দুদের ক্ষেত্রে যেটা আমাদের সমাজে আগে প্রবল ভাবে ছিল।এখনও মুক্ত নয়।

তবে হিন্দু জনগোষ্ঠী কম হওয়ায় ছুটা হিসেবে তাদের তেমন দেখা যায় না। এ জন্য চিত্রটা খুব স্পষ্ট না হলে অবস্থা এমনই হবে। আর বাঁধা লোক! সে তো অসম্ভব,না খেয়ে থাকবে কিন্তু হিন্দু হলে মুসলিম বাসায় আর মুসলিম হলে হিন্দু বাসায় কাজ করবে না । এই চিত্রটা ক্রমশ্য বাড়ছে। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষিত আমরাই এই দোষে দুষ্ট সেখানে সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বঞ্চিত রত্না আমাকে চমকে দিয়ে বললো

–আপনিও মানুষ ,আমিও মানুষ ,সমস্যা কী,সবার গায়ে তো এক রক্ত।

আমি রিনাকে বললাম,তোমার রত্না তো সত্যিই রত্ন! ও তো আপাদমস্তক মানুষ।

–কেন ,কী হলো ?

রিনাকে খুলে বললাম সব। রিনা জানাল ,মেয়েটা ভালো।শান্ত, কাজ কর্ম কথা বার্তা সব ভালো ওর।

রত্নার খোঁজ কোথায় পেলো সেটা জানতে গিয়ে রত্নার ওমানে থাকার কথা জানলাম। আমার অবাক লাগল বিদেশে চার বছর থেকে এসেও রত্না কেন ঢাকাতে কাজ করতে এলো। চার বছর পর ফিরে অর্জিত অর্থ দিয়ে কিছু একটা করতে পারতো। ছেলে-মেয়ে দুটো এতোদিন পর মাকে পেত। আসলে এই কৌতুহল এবং বিদেশে নারী শ্রমিকদের জীবন সম্পর্কে জানতে ওর সঙ্গে আলাপ জমালাম।

বিদেশ চার বছর থেকে একটা মানুষ আবার কেনো কাজের সন্ধানে ঢাকা এলো ব্যাপারটি কেমন যেন। বিদেশ থেকে যথেষ্ট টাকা নিয়ে আসার কথা রত্নার । আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলাম

–রত্না তুমি তো অনেক বুদ্ধিমতি , চারটি বছর তো অনেক সময়,এবং বলছো বেতনও বেশ ভালো ছিল। তা ছাড়া কোনও কেনা-কাটাও করোনি,তোমার জন্যও না তোমার মেয়েটার জন্যও এক রতি সোনা আনলে না, তাহলে তো অনেক টাকা জমা হওয়ার কথা। এরপর বাচ্চাদের ছেড়ে আবার ঢাকা কেন? ওই টাকা দিয়ে একটা ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারতে,তাহলে তো বাচ্চারা তোমাকে পেত।

-কী যে বলেন আপা ! সে টাকা থাকলে কি আর আপনাদের সাথে দেহা হতো? গরীবের দুঃখ শেষ হয় না আপা।

–মানে কি? টাকা নেই মানে ! জমিয়েও রাখনি, সম্পদও বানাও নি, তবে কী করলে সব টাকা?

–সব আমার স্বামীর হাতে দিছিলাম আপা,কইছিল একটা ব্যবসা করবে,এই বলে এলাকার এনজিও থেকেও একলাখ টাকাও লোন নিচ্ছিল , আমাকে জিম্মাদার করে। এখনও সে লোন টানতাছি । একটা মটর সাইকেলও কিনার টাকা দিছিলাম।

–তা সব কই গেল?

–সব ধূলিস্যাৎ করে ফেলেছে আপা। আমি এখন দেনার দায়ে জর্জরিত,আক্কেল সেলামী আপা। সব আমার কপালের দোষ।

তুমি এতদিন ধরে ঘর করছো লোকটাকে চেন না? দেশের বাইরের কঠিন জীবনও দেখে এলে, এরপরও সেই গতানুগতিক বাঙালি বউ!

–ভাবছিলাম শুধরোই যাবে,এতো কষ্টের টাকা নষ্ট করবে না। তাই যা কইছিল তাই করছিলাম।

–তা তো বুঝলাম, তোমার অসীম স্বামী-ভক্তি । এখন কী করছে তোমার পতি দেবতা?

–সব টাকা উড়ায় ফেলাইছে আপা।
যা করছে সব লছ করছে । একটা টেম্পু কিনছিল তাও বেঁচে ফেলাইছে ।

–আচ্ছা, এতো কিছুর পরেও তোমার ওই লোকের সঙ্গে থাকতে হবে কেন? তাকে লোন নিয়ে মটর সাইকেল কিনে দিতে হবে কেন? তুমি জানতে না লোকটাকে,তার স্বভাব-চরিত্র তো তোমার মতো বুদ্ধিমতির অজানা থাকার কথা নয়।

বাঙালি মেয়ে স্বামী স্বামী করেই গেল!

–আপা,ছোট কালে বাপ হারাইছি,বাপ না থাকোনের কষ্ট সারাজীবন দিয়ে বুঝছি। সমাজে যার বাপ নাই তার অনেক জ্বালা আপা। তাই ভাবতাম কী, আমার পোলাপান দুডোর বাপ যেন থাহে, আমার মতো বাপ হারা হোক ওরা, সেটা চাই নাই আপা। তাই বারবার সহ্য করে নিতাম ,ভাবতাম পোলাপান বড় হলি ঠিক । তাই ভাবে ভাবে সব দিছিলাম আপা।

–তা এখন কী করছে তোমার শখের স্বামী , তোমার বাচ্চাদের দায়িত্ববান বাপ!

–আর জিগাইয়েন না আপা। কষ্টের কথা আর কইতে চাই না।
–কেন,ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছে?
–তা তাড়ালেও তো বাঁচতাম আপা।
–তাইলে কী করছেন তিনি ?
–আপা আমার সংসারের হাড়ি-পাতিল,ল্যাপ-খেতা ,
টাকা-পয়সা সব নিয়ে নতুন সংসার পাতচ্ছে। আর আমার ঘামের টাকায় কেনা মটর সাইকেল নতুন বউ লয়ে আমার ঘরের সামনে দিয়ে ঘুরতাছে।

রত্নার মুখের দিকে অপলক চেয়ে আছি-মুখে ভাষা নেই, বাকরুদ্ধ।

লেখকঃ অধ্যাপিকা ডঃ নীলিমা শীল,কবি,সাহিত্যিক ও গবেষক।

আরও পড়ুন