Ads

বিছানা নাম্বার ৩২

-মৌলী আখন্দ

“বিছানা নাম্বার ৩২, ৩৩, ৩৪, ৩৫, ৩৬ এর লোক সামনে আসেন। বিছানা নাম্বার ৩২, ৩৩, ৩৪, ৩৫, ৩৬ এর লোক স্ক্যাবুর সামনে আসেন।“
মাইকিং করে কাউন্সিলিং এর খাতা হাতে নিয়ে সামনে গিয়ে বসল মৌটুসি। এটা স্ক্যাবু অর্থাৎ স্পেশাল কেয়ার বেবি ইউনিট। এক থেকে আটাশ দিন পর্যন্ত বয়সী বাচ্চাদের রাখা হয়। জীবাণু সংক্রমণের ভয় থাকার কারণে রোগীর লোক, বাচ্চার মা বাবা কারোরই এখানে ঢোকার অনুমতি নেই। তাই প্রতিদিন সকাল এগারোটা থেকে বারোটা পর্যন্ত কাউন্সিলিং টাইম। এই সময় মৌটুসির মত ডিউটি ডাক্তাররা কাউন্সিলিং খাতা হাতে নিয়ে স্ক্যাবুর বাইরে রাখা চেয়ার টেবিলে বসে রোগীর লোকদের সাথে কাউন্সিলিং করে, রোগীর আপডেট জানায়। শুরু করার আগে মাইকিং করে যায় যেন সব রোগীর লোক আসে, কেউ ভুলে না যায় কিংবা বাদ না পড়ে যায়। প্রত্যেক ডাক্তার এখানে পাঁচটা করে বেড দেখে। মৌটুসির ভাগের বেড নাম্বার ৩২ থেকে ৩৬ পর্যন্ত।
এক একজন রোগীর লোকের সাথে কথা বলছে আর খাতায় সই নিচ্ছে মৌটুসি। এই সিস্টেম চালু করার কারণ হচ্ছে রোগীর লোকেরা পরে এসে বেমালুম মিথ্যা কথা বলে। অম্লান বদনে বলে দেয় “তিন দিন ধরে বাচ্চার খবর পাই না।“ অবশ্য সব সময় যে তারা বুঝে বলে তাও নয়। হয়ত বাচ্চার চাচা এসে কথা বলে গেছে সকালে। বাকিদের রোগীর আপডেট জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি। বিকেলে মামা এসে বলল “কই আমরা তো কিছুই জানি না, কেউ কিছুই বলে না।“ এ কারণেই কাউন্সিলিং খাতার সিস্টেম চালু করা।
সব রোগীর লোকের সাথে কথা বলে বলে লিস্টের পাশে টিক চিহ্ন বসাচ্ছে মৌটুসি। শুধু ৩২ নাম্বার বাকি। এখনও আসছে না কেন? বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে গেল তার। কতক্ষণ অপেক্ষা করবে। দুনিয়ার কাজ বাকি। ৩৫ নাম্বার ছুটি হবে। ছুটি লিখতে হবে। ৩৩ নাম্বার সার্জারিতে কল লিখতে হবে। ৩৪ নাম্বার ব্লাড পাবে। ৩৩ নাম্বারের সাকশন লাগবে। ৩২ নাম্বারের ফ্রেশ অর্ডার। কখন করবে এইসব? একবার ওয়ার্ডের ভেতরে ঢুকে ওয়াশ নিয়ে কাজ শুরু করবে, দেখা যাবে এই রোগীর লোক তখন এসে উপস্থিত হয়েছে।
মৌটুসি গেটে দাঁড়ানো সিকিউরিটির লোককে বলল, ’ভাইয়া ৩২ নাম্বারের লোক ডাকেন তো!”
সিকিউরিটির লোক কিছুক্ষণ হাঁকডাক করে ফিরে এল। কেউ নেই।
বাধ্য হয়ে মৌটুসি ভেতরে গিয়ে মাইকিং করল আবার। “বিছানা নাম্বার ৩২ এর লোক স্ক্যাবুর সামনে আসেন!”
“এই, তুমি কাকে ডাকছ?” পেছন থেকে সি এ আপু বললেন।
“কেন আপু?”
“৩২ এর মা তো আসতে পারবে না!”
“অন্য কেউ আসবে!”
“ওহ, তুমি তো কিছুই জানো না, ভুলেই গিয়েছিলাম গতকাল তো তোমার ডে অফ ছিল!”
“মানে?”
আপু অকারণেই গলা নামিয়ে বললেন, “৩২ এর মা তো পাগলী, ওর তো মা ছাড়া আর কেউ নেই! লেবার পেইন শুরু হওয়ার পর কে যেন ওকে মেডিকেলের ইমার্জেন্সিতে এনে ছেড়ে গেছে! এখনও লেবার ওয়ার্ডে ভর্তি!”
মৌটুসি চমকে উঠল। নিজের অজান্তেই পায়ে পায়ে ৩২ নাম্বার বিছানার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কি সুন্দর দেবশিশুর মত বাচ্চাটা! মাথা ভর্তি ঘন কালো ঘাসের বাগানের মত রেশম রেশম চুল। কি সুন্দর গোলাপি ঠোঁট! ওমা ওমা ঘুমের ঘোরে ঠোঁটের প্রান্ত বাঁকা করছে দেখ! কাঁদবে নাকি? নাহ, এই তো বাবুর ঠোঁট আবার হাসির ভঙ্গিতে বেঁকে যাচ্ছে। আহ কি মিষ্টি হাসি! দেখলে বুকের ভেতর মুচড়ে ওঠে।
মৌটুসি নিজের অজান্তেই বলে ফেলল, “আপু, ওকে আমায় দেবেন?”
সি এ আপু হেসে ফেললেন। “আমি দেওয়ার কে? তুমি ম্যাডামের সাথে কথা বলে দেখ!”
“আচ্ছা” বলে ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে সরে এল মৌটুসি। আগেই ম্যাডামকে বলা যাবে না। আগে রূপমের সাথে কথা বলে নিতে হবে। ওর অনুমতির ব্যাপার আছে। বিয়ের পর প্রায় চার বছর হতে চলল এখনও মা হতে পারেনি মৌটুসি। প্রতিদিনই এই নিয়ে শাশুড়ির কথা শুনতে হচ্ছে। কিন্তু মৌটুসি জানে সে বন্ধ্যা নয়। কারণ সে বিয়ের আগে একবার মা হয়েছিল। তার আর রূপমের প্রেমের বিয়ে। প্রেমের উত্তাল সময়ে অনেক যুবক যুবতীই যে ভুল করে বসে ওরা দুজনেও তাই করে ফেলেছিল। কেউ যেন জানতে না পারে এইজন্য মেডিকেলে যায় নি তারা, গিয়েছিল এক অখ্যাত ক্লিনিকে। আর সেখানেই অদক্ষ হাতে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত প্রেমের ফসল উপড়ে ফেলতে গিয়েই মৌটুসির জরায়ুতে সংক্রমণ হয়, যাকে বলে পি আই ডি। সেখান থেকে সেকেণ্ডারি ইনফার্টিলিটি। সেকারণেই রূপম মৌটুসির দিকে আঙুল তোলে না কখনো, কারণ এই দুর্ভাগ্যের কিছুটা দায় তো তার উপরেও বর্তায়।
কিন্তু শাশুড়ি তো আর মৌটুসির আগের গর্ভধারণের খবর জানেন না। তিনি দুবেলা নিয়ম করে মৌটুসির বন্ধ্যাত্বের খোঁটা দেওয়াকে কর্তব্য বলে মনে করেন। মৌটুসির আজকে আর কাজে মন লাগছে না। সে অতি দ্রুত সব কাজ শেষ করতে গিয়ে আরও দেরি করে ফেলছে। ছুটির কাগজ লিখতে গিয়ে ভুল করে ফেলল। নতুন কাগজ নিয়ে নতুন করে লিখতে গিয়ে আবারও ভুল।
সি এ আপু ওর অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন,” তুমি বরং আজকে চলে যাও। আমি বাকিটুকু ইন্টার্নকে দিয়ে করিয়ে নেব।“
হাঁফ ছেড়ে বাঁচল মৌটুসি। বের হয়েই রূপমকে ফোন করল। ধরল না রূপম। ধরবে না জানা কথা। মৌটুসি যখন রিকশায় তখন রূপম ফোন ব্যাক করল।
“হ্যালো!”
“কিছু বলতে চেয়েছিলে?”
“আসতে চেয়েছিলাম তোমার কাছে!’
“কেন, কোনো দরকার?”
“নাহ, কোনো দরকার না, এমনিতেই!”
“সম্ভব না। আজকে আমাদের রুটিন ওটি।“
মৌটুসি মনে মনে বলল, “জানি! ওটি না থাকলেও তোমার কিছু না কিছু থাকেই! একই হাসপাতালে কাজ করি আমরা, কিন্তু কাজের ফাঁকে দেখা করা কত মুশকিল! অথচ বিয়ের আগে ক্লাসের ফাঁকে কতবার লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা করতাম!”
“কিছু বলবে? বললে বলে ফেল!”
মৌটুসি একটা শ্বাস ফেলে বলল, “না, কিছু বলব না!”
“আমি রাখছি তাহলে।“
শেষ মুহূর্তে মরিয়া হয়ে বলে ফেলল মৌটুসি, “আমরা কি একটা বাচ্চা এডপ্ট করতে পারি না?’
ফোনের ওপাশে পিন পতন নীরবতা।
“রূপম? কিছু তো বল?”
“বাসায় এসে এই ব্যাপারে কথা হবে” বলে ফোন রেখে দিল রূপম।
রূপমের বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে দশটা। এসেই গোসল সেরে খেয়ে বিছানায় চলে গেল সে। টেবিল গুছিয়ে বিছানায় গিয়ে মৌটুসি দেখল সারা দিনের পরিশ্রমের ক্লান্তিতে রূপম ঘুমিয়ে কাদা। ওকে আর জাগাল না সে। গভীর রাত পর্যন্ত ফেসবুকের পাতায় ঘুরে বেড়িয়ে অবশেষে ক্লান্ত হয়ে নিজেও ঘুমিয়ে পড়ল। সারা রাত স্বপ্নে ঘোরাফেরা করল ৩২ নাম্বার বিছানার বাচ্চাটির মুখ।
পরদিন সকাল। মৌটুসির ইভিনিং ডিউটিও আছে তাই একটু দেরিতেই বিছানা ছাড়ল সে। উঠে দেখে রূপম বেরিয়ে গেছে আগেই। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল নিজের অজান্তেই। ওর সাথে আর বাচ্চাটা নেওয়ার ব্যাপারে কথা বলা হল না। বাচ্চাটির চেহারা আজকে আরও মায়াকাড়া লাগছে। সব কাজ দ্রুত হাতে শেষ করে ফেলে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বসে রইল মৌটুসি। সি এ আপু এসে ঠাট্টা করে গেলেন।
“কী নাম রাখবে ঠিক করেছ?”
মৌটুসি বাচ্চাটার রেশম চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “প্রিয়দর্শিনী!”
“বাব্বাহ! আর কোন স্কুলে পড়াবে? সেই স্কুলেও বুকিং দিয়ে দাও, যদি পরে সিট না পাওয়া যায়?”
“স্কুলে দেব না, সব কাজ ছেড়ে দিয়ে আমি নিজেই বাসায় বসে পড়াব! এতক্ষণ বাচ্চাকে না দেখে আমি থাকতেই পারব না!”
সি এ আপু ওর দিকে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চলে গেলেন।
রাতে বাসায় কথাটা তুলতেই তুমুল চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। রূপম নিজের সিদ্ধান্তে কোনো কাজ করতে পারে না। সব কাজে মায়ের মতামত নেওয়া চাই তার। আর মতামত চাইতে গিয়েই তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেল। শাশুড়ি কিছুতেই রাজি হলেন না। রাতে খেল না মৌটুসি। ঘরের বাতি নিভিয়ে শুয়ে রইল চুপচাপ। রূপম ঘাঁটাল না ওকে।
পরদিন মৌটুসি সি এ আপুকে বলল, “আপু, আমার বেড চেঞ্জ করে দিন! আমার পেছন দিকের বেড, রাউন্ড দিতে দেরি হয়, আমি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না! আমার কষ্ট হয়!”
“ওমা, কী হল আবার?”
“কিছু না আপু, আমাকে প্রথম দিকের বেড দিন!”
জোরাজুরি করে বেড নাম্বার এক থেকে পাঁচের দায়িত্ব নিয়ে ওই বেডগুলোর দায়িত্বে যে ডাক্তার ছিল তাকে ৩২ থেকে ৩৬ নাম্বার বিছানার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিল মৌটুসি। বেড নাম্বার ৩২ স্ক্যাবুর ওই মাথায়, ভুলেও উঁকি দিয়েও সেদিকে দেখতে গেল না। রাউন্ডে নিজের বেডের রাউন্ড শেষ হয়ে যেতেই কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল। বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ হচ্ছে তার। খুব মন চাইছে ৩২ নাম্বার বেডের বাচ্চার খবর জানতে। কিন্তু সে ইচ্ছে করেই ৩২ নাম্বার বেডের ডাক্তারকেও এড়িয়ে গেল, যদি মনের ভুলে জিজ্ঞেস করে ফেলে!
কাজ শেষ করে সে রেজিস্ট্রার আপুদের কাছে গেল তার প্লেসমেন্ট স্ক্যাবু থেকে বদলে দিতে। এই ওয়ার্ডেই আর কাজ করতে চায় না সে। দূরে চলে যেতে চায় যতদূর সম্ভব। পরের সপ্তাহ থেকে তার প্লেসমেন্ট হল অন্য ইউনিটে। নিজেকে কাজে আর পড়াশোনায় ডুবিয়ে দিল মৌটুসি। ইচ্ছে করেই পর পর কয়েকটা প্রেজেন্টেশন নিল যেন ব্যস্ত থাকা যায়। কিন্তু তারপরও বেশ কয়েকদিন লাগল তার এই ক্ষত ভুলতে। পরের মাসে লগবুকে সাইন নেওয়ার জন্য আবার স্ক্যাবুতে গেল মৌটুসি।
সি এ আপু বললেন, “এসো মৌ, চা আনিয়েছি মাত্রই, এসো খেয়ে যাও!”
একথা সে কথার পর সি এ আপু হঠাত বললেন, “জানো মৌ, তোমার প্রিয়দর্শিনী মারা গেছে।“
মৌটুসির হাত থেকে লগবুক পড়ে গেল নিচে। সি এ আপু আপন মনে বলে চললেন, “ওর পাগলী মাটা লেবার রুম থেকে কোথায় যেন চলে গেল একা একা! কেউ খুঁজে পায়নি! আর মেয়ে বাচ্চা বলে কেউ দত্তকও নিল না ওকে। আমরাই বা কতদিন সুস্থ বাচ্চা ওয়ার্ডে রাখব? পুওর ফাণ্ড থেকে, সমাজকল্যাণ থেকে দুধ ডায়াপার ফিডার কিনছিলাম, কিন্তু তাও বা কতদিন চালানো যায়? ওকে পরে আমরা সরকারি অনাথাশ্রমে দিয়েছিলাম। সেখানে একটা বাচ্চার পক্স হয়েছিল। আর জানোই তো পক্স কত ছোঁয়াচে, আর অনাথাশ্রমের বাচ্চাগুলোকে রাখেও কত ঘেঁষাঘেঁষি করে! সারা অনাথাশ্রমে পক্স ছড়িয়ে গেল। তখন ওরও পক্স হয়ে ইনফেকশন হয়ে মরে গেল! ওখানে কে আর দেবে দামি এন্টিবায়োটিক?”
মৌটুসির চোখ বেয়ে দরদর করে জল গড়িয়ে পড়ছে। সদ্য সন্তানহারা এক মায়ের মতই ডুকরে ডুকরে কাঁদছে মৌটুসি। যে সন্তানকে ও কোনোদিন পেটে ধরেনি।

মৌলী আখন্দ-সাহিত্যিক ও চিকিৎসক। 

আরও পড়ুন