Ads

হেকমত আলীর হেকমত

আসাদ বিন হাফিজ

হেকমত আলী মামার সাথে আবারও দেখা হয়ে গেল। আমি মোটেই এজন্য প্রস্তুত ছিলাম না। হাট থেকে বাড়ি যাবো এ জন্য লঞ্চঘাটে বসে আছি এসময় তিনি এলেন। আমাকে দেখেই একগাল হেসে বললেন, বাড়ি যাবি বুঝি? তা কি বাজার করলি?
আমি উত্তর দেয়ার আগেই তিনি দক্ষিণ দিকে ফিরে বললেন, দেশটা চোর ডাকাতে ভরে গেছে। বুঝলি ভাগিনা, মনে হয় কেয়ামতের বেশী বাকি নাই। আমি অবাক হয়ে বললাম, কি কন মামা?

মামা একটা কাঠের টুলে বসতে বসতে বলল, যা বলি মনে করিস না এসবের কোন হাকীকত নাই। আচ্ছা, বলতো, কারো জিনিস না বলে নেয়াকে কি বলে? আমি মুখ একটু কালো করে বললাম, মামা, আমি জানি, আমি কিছুটা বোকা আছি। কিন্তু কারো জিনিস না বলে নেয়াকে যে চুরি বলে, এটা আমি কেন, দুনিয়ার সবাই জানে। মামা বললেন, বাহবা, তোরতো ইদানিং বেশ বুদ্ধি হয়েছে দেখছি। তাহলে এবার বলতো, কোনো কর্ম সম্পাদন করা বেশী গুরুত্বপূর্ণ নাকি তার নিয়ত করা? এবার আমি একটু মুচকি হাসলাম। বললাম, এর উত্তর কিন্তু আমি জানি। মামা বললেন, তাহলে বলে ফেল। বললাম, নিয়ত, মামা।
মামা আমার দিকে সবজান্তার মতো তাকিয়ে বললেন, এটা সব সময় ঠিক না-ও হতে পারে।। আমি মামার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম, যেমন?

তাহলে একটা গল্প শোন।
এক লোক ওয়াজে গিয়ে শুনলো, মদ খাওয়া হারাম। হুজুর আরো বললেন, আমাদের উচিত মন্দ কাজে বাঁধা দেয়া। লোকটা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো, সে এখনি মন্দ কাজের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমে পড়বে। লোকটা একটা ‘বারে’ ঢুকলো। মদ খাওয়া হারাম। এটা বন্ধ করতে হবে। সে এক বোতল মদ লুকিয়ে পালাতে গিয়ে দারোয়ানের হাতে কট খেলো। দারোয়ান তাকে বেঁধে রেখে পুলিশে খবর দিল। পুলিশ এলে বললো, স্যার, একে আমি বোতলসহ পাকড়াও করেছি।
পুলিশ লোকটিকে বলল, এ যা বলছে সব ঠিক?
লোকটি বলল, জ্বি স্যার।
তুমি বিদেশী মদের এ দামী বোতলটি চুরি করলে কেন?
তখন সে ওয়াজের কথা বলল। বলল, হুজুর বলেছে, মন্দ কাজে বাঁধা দিলে সওয়াব হবে। আমি ভাবলাম, একটা বোতল সরাতে পারলে একজন লোক অন্তত এ হারাম মদটুকু খেতে পারবে না। বিশ্বাস করেন, আমি সওয়াবের নিয়তে একটা লোককে পাপ থেকে বাঁচাতেই এ কাজ করেছি। পুলিশ বলল, ভাল করেছিস, এখন চুরির দায়ে হাত কড়া পরে থানায় চল।
আমাদের দেশে এরকম ভাল কাজের নিয়তে কত যে খারাপ কাজ হচ্ছে।

আমি বললাম, হেকমত মামা, লোকটা আমার চেয়েও বোকা। চুরিই যদি করবি তো হারাম মাল কেন, ভাল কিছু করতে পারলি না? হুজুর তো ওয়াজে কোরান পড়তেও বলেছিল। তুই মদ না নিয়ে একটা কোরান শরীফ সরাতে পারলি না? পাশের এক যুবক আমাদের কথা মন দিয়ে শুনছিল। আমি আর কিছু বলার আগেই যুবক আমার কলার ধরে দাঁড় করিয়ে বলল, কী, মসজিদ থেকে কোরআন শরীফ চুরি! ওরে পাপিষ্ঠ, তোর জায়গা তো দোযখেও হবে না। ভাগ্যিস মামা ছিল, নইলে আমার জানটাই কেড়ে নিত যুবক।
সেইদিন থেকে জানলাম, ভাল জিনিস চুরি করলে পাপ আরো বেশী হয়। লোকটা আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, লঞ্চটা এসে গেল বলে বেঁচে গেলি।
হেকমত মামা আমার কানের কাছে মুখটা এনে বলল, চুপ, এই লঞ্চে যাওয়া যাবে না। লঞ্চে যুবক আবার ঝামেলা পাকাতে পারে।
লঞ্চ চলে গেল। হেকমত মামার হেকমতে বেঁচে গেলাম সেদিন। মামা নৌকা ভাড়া করে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল।
নৌকায় বসে মামা বলল,

শোন, আমাদের দেশটা পাপে ভরা। খারাপ লোকেরা তো পাপ করেই, ভাল লোকরাও কম যায় না। স্কুল কলেজে ছাত্ররা নকল করে বহিস্কৃত হয়। কিন্তু মাদ্রাসায় ভুল হলে গুণাহ হবে ভয়ে কোরআনের আয়াত পরীক্ষার সময় দেখে দেখে লেখলে হুজুররা তা চেপে যায়। কারণ, জানাজানি হলে মাদ্রাসার বদনাম হবে, লোকজন দান সদকা কমিয়ে দেবে, কতরকম ভয়।

আমি কিছুটা মন খারাপ করে বললাম, মামা, শুধু শুধু তুমি ভাল লোকগুলোর মাঝে দোষ খুঁজে বেড়াও।
সাদা কাপড়ে ময়লা একটু বেশীই দেখা যায়। মনে কর তুই একটা জামা বানালি। জামাটার মালিক কে? বললাম, আমি।
তুই যদি এটা দান করে দিস বা বিক্রি করিস তখন যে কিনবে এটা তার। এখন কেউ একটা বাড়ি বানালো। যিনি বানালেন বাড়ি তার। সৃষ্টির মালিক স্রষ্টা– এটা হচ্ছে সহজ নিয়ম। বিক্রি বা দান করার আগ পর্যন্ত জয়নুলের ছবির মালিক জয়নুল, রবীন্দ্রনাথের গান কবিতার মালিক রবীন্দ্রনাথ। যিনি যেটা সৃষ্টি করেন, সেটা তার। এর নাম মেধাস্বত্ত্ব। একটা গান যখন কেউ লেখেন তার মালিক তিনি। সেই লেখাতে যদি কেউ সুর দিতে চান তখন সুরকার সেটি কিনে নেবেন বা অনুমতি নেবেন। যদি সেই গানটি কেউ গাইতে চান তবে তিনি গীতিকার ও সুরকারের কাছ থেকে গানটি কিনে নেবেন বা অনুমতি নেবেন। সে গানটি যদি কোন প্রতিষ্ঠান বাজারজাত করতে চান তবে তারা গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীর কাছ থেকে গানটি কিনে নেবেন বা বাজারজাত করার অনুমতি নিবেন।
গানটির মূল মালিক গীতিকার, সুরের মালিক সুরকার, গাওয়ার মালিকানা শিল্পীর। গানটি যদি বিক্রি হয়ে না থাকে, তবে গীতিকার একাধিক সুরকারকে সেটা সুর করতে দিতে পারবেন, যদি সুরটি শিল্পী কিনে না নেন তবে সুরকার একাধিক শিল্পীকে সেটা গাওয়ার জন্য দিতে পারেন।
এই প্রক্রিয়া একটু জটিল হলেও এটাই ইনসাফের দাবী।

এটাকে সহজ করা যায় এভাবে, বইয়ের লেখক মূল মালিক হলেও ব্যাবসা করেন একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান। তিনি লেখকের সাথে এইমর্মে চুক্তিবদ্ধ হন যে, লেখক রয়ালিটি হিসাবে একটা অংশ পাবেন কিন্তু প্রকাশক প্রকাশনার যাবতীয় খরচ, প্রচ্ছদ, কাগজ, ছাপা ইত্যাদি বহন করবেন এবং লাভ তিনি ভোগ করবেন। তেমনি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গীতিকারের সাথে চুক্তিবদ্ধ থাকবেন এবং সময় সময় হিসাব করে রয়ালিটি প্রদান করবেন।

এ ক্ষেত্রে আরেকটি জিনিস বিবেচনা করলে আরো যুক্তিযুক্ত হয়। সেটা হলো, লেখক শিল্পীদের আর্থিক অবস্হা বরাবরই নাজুক থাকে। অনেক লেখক শিল্পীকে শেষ জীবনে বিনা চিকিৎসায় মরতে হয়। যেহেতু যিনি গানটি গান তিনি বিভিন্ন মিডিয়ায় গানটি পরিবেশন করতে পারেন, তিনি বিভিন্ন সভা, মাহফিলে গান পরিবেশন করে সম্মানী, তোহফা, বকশিশ পান সেহেতু শিল্পীর সম্মানী উন্মুক্ত করে দিয়ে, গীতিকার ও সুরকারকে ব্যবসায়ীক রয়ালিটিতে যুক্ত করা যায়। এতে কৃষক যেমন নিয়মিত ফসল পায়, চাকরীজীবী বেতন পায় তেমনি পরিমানে কম হলেও তাদের এই কাজ নিয়মিত আয়ের একটা সোর্স হতে পারে।নইলে পরের সম্পদ দিয়ে একদল হবে চোর বা ডাকাত, আরেকদলের মেধা তার জীবনধারনে কোন কাজেই আসবে না।

কিন্তু মামা, তুমি জানো না, এখন কিছু গীতিকার বেরিয়েছে যারা সুরকারকে উল্টো পয়সা দিয়ে গান সুর করিয়ে নেয়। বইয়ের মালিক লেখক। যিনি প্রচ্ছদ করেন প্রকাশক তার কাছ থেকে সেটা কিনে নেন বলে প্রচ্ছদ শিল্পী একবারই টাকা পায়। তেমনি গানের মালিক গীতিকার থেকে যারা প্রযোজনা করবেন তারা চুক্তি করবেন লেখকের সাথে। লেখক নির্দিষ্ট সময়কাল বা পরিমান নির্দিষ্ট করে এই চুক্তি সম্পাদন করবেন। মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে লেখক নতুন করে তার সাথে বা অন্যকারো চুক্তিবদ্ধ হবেন। এটা হলে তো প্রচ্ছদ শিল্পীর মত সুরকারও সুরের জন্য এককালীন পয়সাই পাবেন।
প্রকাশক ও লেখক যেমন চুক্তিবদ্ধ হন তেমনি এখানে গীতিকার ও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান চুক্তিবদ্ধ হবে। তাহলেই তো সমস্যা থাকে না।
বাহ, এইতো দেখি তোরও বুদ্ধি খুলছে।
মামা, আমি তোমার সাথে একমত। অপরের সম্পদ নিজের দখলে নেয়া যেমন পাপ, অপরের মেধাসম্পদ দখলে নেয়াও সমান অপরাধ।
মামা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মনে রাখতে হবে, চুরি চুরিই। সে যেই করুক আর যে প্রকারেই করুক।
ঠিক বলেছেন মামা, ইউটিউবে এখন বহু ইসলামী গান দেখি, যার কোন গীতিকারও নেই, সুরকারও নেই। এগুলো কি জ্বিনে লেখে আর ফেরেশতারা সুর দেয়?

মামা হাসলেন, ভাগিনা, ছোট মানুষ, তোকে কি বলি? সব জায়গায় ভেজাল। ইসলামেও ভেজাল মিশে গেছে। ইসলাম ছিল পুতপবিত্র। কোরআন ও হাদীসে সীমাবদ্ধ। দিনে দিনে ময়লা কেবল বাড়ছেই। ইসলাম চর্চা বাদ দিয়ে এখন ইসলামের ফেরিওয়ালা চারদিকে। কেউ বেহেশতের টিকেট বিক্রি করে। কেউ দোয়া তাবিজ বিক্রি করে। কেউ জাহাজে করে মানুষকে জান্নাতে নিয়ে যায়। কেউ হালাল পতিতালয় বানায়। কারো ইসলাাম মিষ্টি খাওয়া সুন্নতে। কত ফের্কা, কত পীর, কত দরবেশ। ইসলাম যেনো একটা বিরাট শেয়ারমার্কেট। কার টাকা কে যে লুট করে খায়। একেই বলে মডার্ন হেকমত।

জমি ও বউয়ের সোনা বিক্রি করে যারা শেয়ারের মালিক হয় তারা যেমন সে টাকার হদিস পায়না, ইসলামী সংস্কৃতিতে তেমনি ইসলামী তরিকায় দরবেশরা সে টাকার মালিক হয়ে যায়। হায়রে দুনিয়া।
লেখকঃ জনপ্রিয় কবি ও সাহিত্যিক

আরও পড়ুন