Ads

কুরআনিক থট প্রসেস: আল কুরআনের চিন্তামানস (৩)

জিয়াউল হক

চুড়ান্ত বিচারে মৃত্যু পরবর্তি জীবনে আল্লাহর কাছ থেকে মুক্তি লাভ ও জান্নাতে দাখিল হতে পারাটাকে আল্লাহ পাক অন্য এক জায়গায় ফউযুল কবির বা মহাসাফল্য হিসেবেও কুরআনে অভিহিত করেছেন। যেমন; যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তাদের জন্যে আছে জান্নাত, যার তলদেশে প্রবাহিত হয় নির্ঝরিণীসমূহ এটাই মহাসাফল্য [ সুরা বুরূজ : ১১] ।

মহাসাফল্য বা সর্বোচ্চ সাফল্য বা কল্যাণ সব একই জিনিস। এটাই হলো মানবজীবনের সর্বোচ্চ সফলতা, সর্বোচ্চ কল্যাণ। কুরআন এটা অর্জনের উপযোগী মানসপট তৈরি করতে চায়। তবে এ পথে আরও কয়েকটি স্তর রয়েছে। রাষ্ট্রনায়ক ও সমাজচিন্তকদের জন্য তাতে ভাবনার খোরাক রয়েছে, কর্মপদ্ধতি, করণীয় ও দায়িত্ব নির্ধারণে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কুরআনের পাতায় আল্লাহ পাক কয়েকটি অভিধা ব্যবহার করেছেন। অন্যতম একটি হলো ‘ফাওযাম মুবিনা’ তথা, প্রকাশ্য কল্যাণ, যেমন বলা হয়েছে; যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে ও সৎকর্ম করেছে, তাদেরকে তাদের পালনকর্তা স্বীয় রহমতে দাখিল করবেন। এটাই প্রকাশ্য সাফল্য। (সুরা যাসিয়া : ৩০)
এখানে ব্যবহৃত ‘মুবিন’ শব্দটির কয়েকটি বহুল প্রচলিত অর্থ হলো; প্রকাশ্য, খোলামেলা, উন্মুক্ত, দৃশ্যমান ইত্যাদি। রাষ্ট্রনায়ক ও রাষ্টপরিচালক এবং সমাজচিন্তক, এমনকি, সমাজের প্রতিটি সচেতন নাগরিকের জন্যই নিজের ও জনগণের এই ‘প্রকাশ্য কল্যাণ’ নিশ্চিত করাটা তাদের প্রত্যেকের রাজনৈতিক, প্রাশাসনিক, সামাজিক ও নাগরিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। বিশ্বাসী অবিশ্বাসী, আপন পর, কাছের বা দূরের প্রত্যেকের ইহকালীন জীবনে সম্ভাব্য সকল ধরনের মানবিক অধিকার ও মর্যাদা প্রদানের মাধ্যমে আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত সকল সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার মাধ্যমে তার ‘প্রকাশ্য কল্যাণ’টা এমনভাবে নিশ্চিত করা হবে যে, তা প্রকাশ্যে দৃশ্যামান ও অনুধাবনীয় থাকবে।

ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল রাজনীতিবীদদের বেলাতে রাজনীতির প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো ‘প্রকাশ্য কল্যাণ’ নিশ্চিত করা। এ উদ্দেশ্যটা রাজনীতিবীদ ও রাষ্ট্রনায়কদের সামনে সুস্পষ্ট থাকলে সমাজ ও সভ্যতার সকল সদস্যই মানবিক ও সামাজিক, রাজনৈতিক ও বৈষয়িক কল্যাণ ও নিরাপত্তা পাবেন।
এই চেতনার পাশাপাশি রাষ্ট্রনায়ক ও সমাজবাসীর মনে যদি আল্লাহ ও তার রাসুল, কুরআন ও ইসলাামি শরিয়তের প্রতি বিশ্বাস ও পূর্ণ ঈমান থাকে, তবে তারা সেক্ষেত্রে নিজেদের এবং সেই একই সাথে সমাজবাসীর সকলের জন্য সর্বোচ্চ, সর্বাপেক্ষা বৃহৎ কল্যাণ নিশ্চিত করতে সামাজিক, প্রশাসনিক, রাজনৈতিক’সহ সকল দিক থেকেই চেষ্টা প্রচেষ্টা করে যাবেন। দায়িত্বটি পালনের পথে মানসিক শক্তি, তাড়া, কর্তব্যবোধ ও দায়িত্ববোধটা আসে আল্লাহ ও তার রাসুল সা: এর উপর বিশ্বাস থেকে। কুরআনুল কারিমেও আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন এ ব্যাপের সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালকদের এটাই হলো প্রধান দায়িত্ব; যেমন কুরআন বলছে;

তারা এমন লোক যাদেরকে আমি পৃথিবীতে শক্তি-সামর্থ, তথা, রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করলে তারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করবে, জাকাত দেবে এবং সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করবে। প্রত্যেক কর্মের পরিণাম আল্লাহর এখতিয়ারভূক্ত।’ (সুরা হাজ : ৪১)

ব্যক্তি ও পারিবার থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে নামাজ প্রতিষ্ঠার কারণে প্রতিটি স্তর থেকেই অকল্যাণ, অনিয়ম, চারিত্রিক ত্রুটি, সামাজিক অনৈক্য, চিন্তার দৈন্যতা দূর হয়ে যায় এবং সেসবের বিপরিতে চিন্তার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, একমূখীতা, সামাজিক ঐক্য, সৌহার্দ, পারস্পরিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা পায়।

এর পাশাপাশি যাকাত ব্যবস্থা তার পূর্ণ রুপ ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত থাকলে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরিভূত হয়, তদস্থলে ভারসাম্যপূর্ণ সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠতে থাকে। বৈষয়িক শোষণের সকল পথ রুদ্ধ হলে সামজিক বিভাজন ও অনৈক্য কমে আসে, কমসুবিধাপ্রাপ্ত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমে আসতে আসতে এক সময় তা দূর হয়ে যায় এবং অসহায় শ্রেণি কর্মক্ষমভাবে সমাজে পূনর্বাসিত হয়ে পড়ে। রাষ্ট্র ও সমাজের উচ্চশ্রেণির সাথে নি¤œশ্রেণির বন্ধন দৃড় হলে তা প্রকারান্তরে রাষ্ট্রের বুনিয়াদি ভিত্তিকেই শক্ত করে। এভাবে একটি বৈষম্যহীন কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

এই কল্যাণরাষ্ট্র তার নাগরিক এবং সীমানায় বসবাসকারীদের সকলের জাগতিক কল্যাণটাকে এমনভাবে নিশ্চিত করে যে, তা দৃশ্যমান হয়ে সকলের সামনে ধরা পড়ে, আমরা কুরআনের সুত্র উল্লেখ করে যাকে ‘প্রকাশ্য কল্যাণ’ বা ‘ফাউযান মুবিন’ হিসেবে উল্লেখ করেছি।

প্রতিটি মানবসন্তানের ক্ষেত্রে দুনিয়ার জীবনে, তথা, ইহকালীন জীবনে ‘হাসানা’ (রাব্বান আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানা’ মর্মে দোওয়ার কথা স্মরণ করুন) লাভের পাশাপাশি পরকালীন জীবনের হাসানা (উক্ত দোওয়ার দ্বিতীয়াংশ ‘ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানা’) বা সর্বোচ্চ সফলতা পেতে পথ চেনানো, অর্জনের পথ বাতলে দেয়া, সে পথে চলার মতো সামাজিক ও পারিপার্শি¦ক উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা, সহযোগীতা করা, সাথে করে নিয়ে সে পথে চলার মাধ্যমে চুড়ান্ত প্রাপ্য ও পুরস্কার পরকালীন জীবনে‘ সর্বোচ্চ কল্যাণ’ বা সর্বাপেক্ষা বড়ো সাফল্য; ‘ফাউযান আজিম’ পায়।

কুরআনিক থট প্রসেস বা কুরআনের চিন্তামানসে রাষ্ট্রচিন্তা ও রাজনীতির মৌলিক কথাই এটা। এটাই হতে হবে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের মূল লক্ষ্য। যদি তাদের সামনে প্রকাশ্য কল্যাণ ও চুড়ান্ত কল্যাণের এই সুক্ষ ও মৌলিক পার্থক্য সুস্পষ্ট না থাকে তবে ব্যক্তি, পরিবার, গোষ্ঠী. সমাজ ও রাষ্ট্র নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হতে বাধ্য।

বলাই বাহুল্য, অধূনা পৃথিবীতে প্রচলিত সকল রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে এটাই ঘটেছে। খোদ সিসেরো (Cicero) তার সকল সদিচ্ছা সত্তেও বিশ্বকে এই পার্থক্যটা নির্দেশ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এর একমাত্র কারণ হলো, তিনি নবুয়ওতের শিক্ষার অনুগামী ছিলেন না। ঠিক একই কারণে বর্তমান বিশ্বও এক্ষেত্রে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ! (সংক্ষেপকৃত)

(চলবে)

আগের পর্ব-কুরআনিক থট প্রসেস: আল কুরআনের চিন্তামানস (২)

ইংল্যান্ডে নিউক্যাসল আপন টাইনের (Newcastle Upon Tyne) দীর্ঘ আটশত বসরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মুসলমান, একজন অশেতাঙ্গ এবং একজন এশিয়ান লর্ড মেয়র হাবিব রহমানের সাথে এক অনুষ্ঠানে লেখক জিয়াউল হক।

লেখকঃ ইংল‍্যান্ডের বেসরকারী মানসিক হাসপাতালের সাবেক উপ-পরিচালক ও লেখক, ইংল‍্যান্ড

আরও পড়ুন