Ads

কুরআনিক থট প্রসেস: আল কুরআনের চিন্তামানস (৪)

জিয়াউল হক 

কুরআন মানবসমাজের ব্যক্তিগত বা সামষ্ঠিক, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয়, তথা, প্রতিটি পর্যায়ে ইতিবাচক মনস্তত্ত (পজিটিভ সাইকোলোজি) সৃষ্টি করতে চায়। এটা ছাড়া ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, সমাজ বা রাষ্ট্র কারো পক্ষেই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন সম্ভবপর নয়। সামাজিক পর্যায়ে ইতিবাচক সামাজিক মনস্তত্ত (Social Psychology) সৃষ্টি ও তার বিষ্ময়কর ফলাফল কি হতে পারে, তার সবচেয়ে বড়ো উদাহারণ আমাদের সামনে রয়েছে প্রিয় রাসুল সা: এর নিজের কর্মপদ্ধতির মধ্যেই। আর সেটা হলো হুদাইবিয়ার সন্ধীর ঘটনা। এটি ছিল মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় আসার ৬ বসর পরের ঘটনা।

ষষ্ঠ হিজরিতে হঠাৎ এক রাতে মহানবী (সা.) স্বপ্নে দেখলেন, মুসলমানরা মসজিদুল হারামে হজ্বের আনুষ্ঠানিকতাগুলো পালন করছে। আল্লাহর রাসুল সা: এর স্বপ্ন, তাঁর সে স্বপ্নের গুরুত্ব ও তাৎপর্যই আলাদা। তিনি স্বপ্নের কথা সাহাবিদের জানালেন এবং একে একটি শুভ আলামত মনে করে বললেন, খুব শিগগিরই মুসলমানরা তাদের মনের আশা পূরণে সক্ষম হবে। দীর্ঘদিন মাতৃভূমি ছেড়ে এসে মহানবী (সা.) ও অন্যান্য মুহাজির সাহাবি রা: গণের মধ্যে নিজ জন্মভূমি সফর করার স্বাভাবিক আগ্রহ ও চাঞ্চল্য ছিল।

ঘর-বাড়ি, ব্যবসা বাণিজ্য আর নিজ নিজ জন্মভূমি ছেড়ে আসা মুহাজির সাহাবিসহ মদিনার আনসারদের জন্য এটা ছিল অত্যন্ত আনন্দের ঘটনা। কারণ প্রাচিনকাল হতেই তারা বসরের নির্দিষ্ঠ সময়ে মক্কায় বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করতে যেতেন। মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বিগত কয়েকটা বসর সামাজিক ও রাজনৈতিক এবং সেই সাথে দুই জনপদের মানুষের মধ্যে সৃষ্ট বৈরি মনস্তাত্তিক সম্পর্কের কারণে সেটা আর হয়ে উঠেনি। কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি মুসলমানদের উমরার জন্য প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দিলেন এবং মদিনার আশে-পাশের যেসব গোত্র তখনও মূর্তিপূজক ছিল, তাদেরও আহŸান জানালেন মুসলমানদের সফরসঙ্গী হতে।

মদিনায় নবগঠিত ইসলামি রাষ্ট্রের মুসলমান, যাদেকে আরবরা ধর্মত্যাগী হিসেবে গণ্য করতো, সেই তারাই কিনা বায়তুল্লাহকে তাওয়াফ করতে যাচ্ছে বিপুল উৎসাহ আর উদ্দীপনার সাথে! বিষয়টা পুরো আরব জনপদে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা আরব গোত্রের কাছে কেমন যেন বেখাপ্পা মনে হতে লাগলো, অবিশ্বাস্য ঠেকলো। কারণ তারা তো জানতো মুসলমানরা বায়তুল্লাহ এবং বায়তুল্লাহতে অবস্থিত তাদের বিভিন্ন উপাস্যদের ঘোরতর বিরোধি!
বায়তুল্লাহ তাওয়াফ ও সফরের সাথে সাথে নানা রসম রেওয়াজ ও সামাজিক প্রথা জড়িত ছিল, মুসলমানরা তারও বিরোধি, অর্থাৎ মুসলমানরা মক্কাবাসীদের সামাজিক প্রথা, যে সব মনস্তাত্তিক আবহের উপরে ভিত্তি করে এই সব প্রথাগুলো গড়ে উঠেছে কিংবা বিদ্যমান রয়েছে, তারও বিরোধি। অর্থাৎ মুসলমানরা আরববাসীর জীবনবোধ, সামাজিক মুল্যবোধ, সামাজিক মনস্তত্তসহ সকল কিছুরই বিরোধি। মক্কাবাসীদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিক নেতৃত্বের পক্ষ হতে তেমনটাই তো প্রচার করা হতো। মুসলমানদের প্রতি বৈরিতা পোষণ করার এটাই ছিল সবচেয়ে বড়ো কারণগুলোর একটি।
অথচ সেই তারা নিজেরাই দেখতে পাচ্ছে বাস্তবে তারা যা শুনে আসছে তার মধ্যে অতিরঞ্জন বা বিকৃতি বা মিথ্যা প্রচারণার উপস্থিতি রয়েছে, রয়েছে ভিন্নতা। তাদের ধারনার বিপরিতে রাসূল (সা.) ও তাঁর সঙ্গীদের উমরা পালনে যাত্রার ঘোষণায় তাদের সেই বিশ্বাসে প্রাথমিক চিড় ধরলো।
মুশরিকদের একটা অংশের গণমনস্তত্তে বা পাবলিক সাইকোলোজিতে এটাই ছিল প্রাথমিক ফাটল, বিরাট একটা ধাক্কা। অপরদিকে আল্লাহর রাসুল সা: কর্তৃক ইতিবাচক বা পজিটিভ সোশ্যাল সাইকোলোজি (Social Psychology) গড়ে তোলার ক্ষেত্রেই এটাই ছিল সবচেয়ে বড়ো পদক্ষেপ। বলাই বাহুল্য, পদক্ষেপটি তিনি নিজ স্বিদ্ধান্তে নেন নি, নিয়েছেন আল্লাহর নির্দেশে। অতএব, আমাদের শিক্ষা রয়েছে এ ঘটনার মধ্যে, সে শিক্ষা প্রতিটি কুরআন পাঠকের জন্যই।

এর আগে ব্যক্তি পর্যায়ে নানা ঘটনার কারণে ব্যক্তিগত বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক পজিটিভ সাইকোলোজি গড়ে উঠেছে, তার ফলও ফলেছে ব্যক্তিপর্যায়েই। যেমন, আমরা হযরত ওমর রা: এর কথা বলতে পারি, নিজ বোন ও ভগ্নিপতির ইসলাম গ্রহণের ঘটনায় ক্রোধে উন্মন্ত হয়ে প্রথমে তাদের প্রহার, তার অগ্নীমূর্তির সামনে হঠাৎ করে আহত বোনের রুখে দাঁড়ানো, কুরআনের আয়াত বা অংশ বিশেষ তেলওয়াতের মাধ্যমে তার মনে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়ার সুত্র ধরে যে পরিবর্তন, সেটা ছিল ইনডিভিজুয়াল সাইকোলোজি বা ব্যক্তি মনস্তাত্তিক পরিবর্তনের ঘটনা।

কিন্তু আলোচ্যক্ষেত্রে, অর্থাৎ হুদাইবিয়ার সন্ধীর পুরো ঘটনাপ্রবাহ এবং তার পরবর্তিতে দ্রুততর সময়ের মধ্যে আরবের বুকে আপামর জনসাধারণের মধ্যে প্রিয় রাসুল সা:, তাঁর মিশন, ইসলাম ও মুসলমানদের নিয়ে যে ইতিবাচক ধারনা তৈরি এবং তাদের সাথে সামাজিকভাবে উঠা বসা সংক্রান্ত যে মানসিক পবির্তন ঘটতে থাকে, সেটা ছিল সামষ্ঠিক ও সামাজিক মনস্তত্বের বিষয়। মনোবিজ্ঞান এবং সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় এটাকেই গণমনস্তত্ত, পাবলিক পারসেপশন (Public Perception/ Communal Perception) বা সোশ্যাল সাইকোলোজি (Social Psychology) হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
বিশ্বের বুকে কোন আন্দোলন. সমাজ পরিবর্তনের কোন চেস্টা প্রচেস্টাই সফল হবে না, কোনদিন হয়ও নি, আদর্শের অনুকুলে এরকম কোন গণমনস্তত্ত তৈরি করা না গেলে। আজ যারা সমাজ পরিবর্তনের, বিশেষ করে, ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী, সবচেয়ে বড়ো কথা, যারা আল কুরআনের পাঠক ও অনুগামী, তাদের সামনে কুরআনের থট প্রসেস বা এর চিন্তামানসকে সঠিকভাবে উপলব্ধী করা ছাড়া নিজ ব্যক্তিচরিত্র, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কোন পর্যায়েই কুরআনের প্রতিনিধিত্ব করা সম্ভবপর নয়। (সংক্ষেপকৃত)

আগের পর্ব-কুরআনিক থট প্রসেস: আল কুরআনের চিন্তামানস (৩)

লেখকঃ ইংল‍্যান্ডের বেসরকারী মানসিক হাসপাতালের সাবেক উপ-পরিচালক ও লেখক, ইংল‍্যান্ড

আরও পড়ুন