Ads

তাহাজ্জুদ নামাযের যত কথকতা

।। শহীদ সিরাজী ।।

সুচনা কথা –
তাহাজ্জুদ অর্থ ঘুম থেকে উঠা। রাতের কিছু অংশ ঘুমিয়ে থাকার পর উঠে নামায পড়া। আরবিতে ‘তাহাজ্জুদ’ (تهجد‎‎) রাতের নামায বা কিয়ামুল লাইল নামেও পরিচিত। পবিত্র কুরআনে এ নামায পড়তে উৎসাহিত করা হয়েছে। এশার নামাযের পর ঘুমিয়ে অর্ধেক রাতের পর উঠে নামায পড়তে বলা হয়েছে। রাসূল (সা) কখনো মধ্য রাতে, কখনো তার কিছু আগে অথবা পরে ঘুম থেকে উঠতেন এবং আসমানের দিকে তাকিয়ে সূরা আলে-ইমরানের শেষ রুকুর কয়েক আয়াত পড়তেন। তারপর মেসওয়াক ও অযু করে নামায পড়তেন।

 

আল কুরআনে আলোকে তাহাজ্জুদ
তাহাজ্জুদ নামায যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমন ফযিলতপূর্ণ ইবাদত। আল্লাহর রাসূল (সা) এ নামায শুধু নিয়মিত পড়তেনই না বরং সাহাবাদেরকেও নিয়মিত আদায়ে উৎসাহ দিতেন।
পবিত্র কুরআন আল্লাহ বলেন –
“হে মুহাম্মদ! আপনি নিদ্রা থেকে উঠে রাত্রির কিয়দংশ থাকতে তাহাজ্জুদ নামায পড়ুন,এটা কেবলমাত্র আপনারই জন্যে অতিরিক্ত করা হয়েছে। সম্ভবত এরই বিনিময়ে আপনার প্রভু আপনাকে প্রশংসিত স্থান দান করবেন।”(সুত্র: বনি ইসরাইল ৭৯)
রাতের ইবাদত প্রসঙ্গে কুরআনে আরও রয়েছে,
“হে বস্ত্র মুড়ি দিয়ে শয়নকারী! রাতের বেলা নামাযে রত থাকো। তবে কিছু সময় ছাড়া অর্ধেক রাত, কিংবা তার চেয়ে কিছু কম করো।অথবা তার ওপর কিছু বাড়িয়ে নাও।
আর কুরআন থেমে থেমে পাঠ করো। আমি অতি শীঘ্র তোমার ওপর একটি গুরুভার বাণী নাযিল করবো। প্রকৃতপক্ষে রাতের বেলা জেগে ওঠা প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে অনেক বেশী কার্যকর এবং যথাযথভাবে কুরআন পড়ার জন্য উপযুক্ত সময়। দিনের বেলা তো তোমার অনেক ব্যস্ততা রয়েছে। নিজ প্রভুর নাম স্মরণ করতে থাকো। এবং সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তাঁরই জন্য হয়ে যাও। (সুত্র: আল মুজ্জাম্মিল, ১-৮)
যারা নিয়মিত তাহাজ্জুদ আদায় করেন কুরআন তাদেরকে সুসংবাদ দিয়েছে। আল্লাহর রহমত এবং আখেরাতে চিরন্তন সুখ সম্পদের অধিকারী বলে ঘোষণা করেছে-
“নিশ্চয়ই মুত্তাকিরা বাগ-বাগিচায় এবং ঝর্ণার আনন্দ ভোগ করতে থাকবে এবং যে সব নিয়ামত আল্লাহ দিতে থাকবেন সেগুলো তারা গ্রহণ করবে। নিঃসন্দেহে পূর্বে তারা মুহসিনীন ছিল।রাতের খুব অল্প অংশেই তারা ঘুমাতো এবং শেষ রাতে ইস্তেগফার করতো।” (সুত্র: সূরা যারিয়াত:১৫-১৮)
হাদিসে আলোকে তাহাজ্জুদ –
শুধু কুরঅান নয় হাদিসেও তাহাজ্জুদের গুরুত্ব ও ফযীলতের অনেক বর্ণনা আছে।
“ফরয নামাযের পরে সব ধরনের সুন্নাত ও নফল নামাযের মধ্যে তাহাজ্জুদের গুরুত্ব ও ফযীলত সবচেয়ে বেশী।” (আহমাদ, মেশকাত ১১০ পৃঃ)
এ ব্যাপারে রাসুল (স) বলেছেন,
“আমাদের প্রভু প্রত্যেক রাতে দুনিয়ার  আসমানে নেমে আসেন যখন রাত্রের এক তৃতীয়াংশ বাকী থাকে। অতঃপর তিনি বলেন, তোমাদের কে আমাকে ডাকবে! আমি তার ডাকে সাড়া দেব ।কে আমার কাছে কিছু চাইবে আমি তাকে তা দেব। কে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করে দেব।(সুত্র: মুসলিম, মেশকাত ১০৯ পৃঃ)
রাসূল (সা) বলেছেন –
“মুসলমানদের মধ্যে আল কোরআনে অভিজ্ঞ ও তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়কারী ব্যক্তি সম্মানের অধিকারী হবেন।” (সুত্র: বায়হাকি)

 

তাহাজ্জুদের গুরুত্ব
মানুষের জীবন ও মননে এ নামাযের গুরুত্ব অপরিসীম। মন ও চরিত্রকে নির্মল রাখতে এবং সত্য পথে অবিচল থাকার জন্যে এ নামায অবশ্যই অপরিহার্য ও কার্যকর পন্থা।
কুরঅান এর যথার্থতা প্রকাশ করে বলেছে –
“বস্তুতঃ রাতে ঘুম থেকে উঠা মনকে দমন করার জন্যে খুব বেশি কার্যকর এবং সে সময়ের কুরআন পাঠ বা যিকির একেবারে যথার্থ।” (সুত্র: সূরা মুয্যাম্মিল-৬)
যারা এমন ইবাদাত করেন আল্লাহ তাদেরকে তাঁর প্রিয় বান্দাই শুধু বলেননি বরং তাদের নেকি ও ঈমানদারির সাক্ষ্যও দিয়েছেন। এ প্রসংগে আল্লাহ বলেছেন –
“আল্লাহর প্রিয় বান্দা তারা, যারা তাদের প্রতিপালকের দরবারে সিজদা করে এবং দাঁড়িয়ে থেকেই রাত কাটিয়ে দেয়।” (সুত্র: ফুরকান:৬৩-৬৪)
হযরত জাবির (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,আমি রাসূলুল্লাহ (সা) কে এ কথা বলতে শুনেছি যে, ‘নিশ্চয়ই রাতের ভেতর এমন একটি সময় আছে, যদি কোনো মুসলমান ওই সময়টি পায়, আর তখন দুনিয়া আখিরাতের কল্যাণ হতে কোনো কিছু প্রার্থনা করে, তাহলে অবশ্যই আল্লাহ তাকে তা দেন। আর এ
সময়টা প্রতি রাতেই আসে।’ (সুত্র : মুসলিম শরীফ)

 

তাহাজ্জুদ নামায এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে পবিত্র হারাম শরীফে ও মসজিদে নববিতে আযান দিয়ে সকলকে আহবান করা হয়। যা অার অন্য কোন নফল নামাযে করা হয় না।
একটা চমৎকার হাদিস -পরিবারের স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের পরিপুরক। তাহাজ্জুদ নামায পড়ার ক্ষেত্রে তারা পরস্পরকে কিভাবে সহযোগিতা করবে রাসূল (সা) তা একটা সুন্দর উদাহরন দিয়ে বুঝিয়েছেন।
তিনি বলেছেন –
“যে ব্যক্তি রাত্রে ঘুম থেকে জেগে তাহাজ্জুদের নামায পড়ে এবং সে তার স্ত্রীকেও ঘুম থেকে জাগিয়ে নামায পড়ায় এমনকি সে যদি জেগে না উঠে, তবে তার মুখে খানিকটা পানি ছিটিয়ে দেয় তাহলে তার প্রতি আল্লাহ রহমত বর্ষণ করে থাকেন। আবার, কোন মহিলা যদি রাতে জেগে উঠে তাহাজ্জুদ নামায পড়ে এবং সে তার স্বামীকে নামাযের জন্য জাগায় এমনকি স্বামী না জাগলে স্ত্রী তার মুখে পানি ছিটিয়ে তার ঘুম
ভাঙ্গিয়ে দেয় তাহলে তার প্রতিও আল্লাহর রহমত বর্ষণ হতে থাকে। (সুত্র: আবু দাউদ, নাসায়ী, মেশকাত ১০৯ পৃঃ)
এ সুন্দর হাদিস থেকে বুঝতে আর কোন অসুবিধা থাকে না, ফরয না হলেও এ নামায পড়াকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা) কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন এবং পড়তে উৎসাহিত করেছেন।
রাসুল (সা) আরও বলেছেন –
“আল্লাহর কাছে অতি প্রিয় নামায দাউদ (আ) এর নামায । তিনি অর্ধেক রাত ঘুমাতেন এবং রাতের তৃতীয় ভাগে নামাযে দাঁড়াতেন আর ৬ষ্ঠ ভাগে আবার ঘুমাতেন।”(সুত্র: বুখারী, মুসলিম, মেশকাত ১০৯ পৃঃ)

 

শেষ কথা
প্রত্যেক মুসলিম আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইবাদাত করে। নিজের ভুল-ত্রুটির জন্য মহান রব্বুল আলামিনের কাছে ক্ষমা চায়। আমরা জেনেছি পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামাযের পর নফলের মধ্যে তাহাজ্জুদ সর্বশ্রেষ্ঠ আমল। আবু হুরায়রা (রা) বর্ণনা করেছেন, রাসুল (সা) বলেছেন –
“ফরয নামাযের পর উত্তম নামায হলো রাতের তাহাজ্জুদ।’ (সুত্র: মুসলিম শরীফ)
অধিকন্তু সয়ং রব্বুল আলামিন বান্দাদের অপরাধ ক্ষমা করার জন্য তাহাজ্জুদ নামাযের সময় পৃথিবীর আসমানে নেমে আসেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীকে খুঁজতে থাকেন। এমন গুরুত্বপূর্ণ, মর্যাদাপূর্ণ, কল্যাণময় যে নামায। সময়ও দোয়া কবুলের উত্তম সময়। তাই আমাদের সকলের উচিৎ দোয়া কবুল ও গোনাহ মাফের জন্য এমন উত্তম সুযোগ গ্রহন করা। আল্লাহ সবাইকে তা পূর্ণ ভাবে আদায় করার তৌফিক দান করুন।
লেখকঃ কবি, সাহিত্যিক ও প্রাক্তন ব্যাংকার 
আরও পড়ুন