Ads

চিকিৎসা, চিকিৎসক, টেস্ট,মানবতা নিয়ে কিছুকথা

ডাঃ আহমেদ জোবায়ের

আমাদের বাংলা সিনেমায় আমরা দেখতাম চৌধুরী সাহেবের পুত্রবধূর হাতের পালস দেখেই ডাক্তার সাহেব ঘোষণা দিতেন হাসিমুখে, চৌধুরী সাহেব আপনি দাদা হতে চলেছেন।বাংলা সিনেমায় দেখানো হতো,ডাক্তার দশ লাখ টাকার জন্য নায়কের মায়ের অপারেশন শুরু করছেনা।ডাক্তার একজন কসাই ও অমানুষ।নায়ক চিৎকার করে বলছেন, ডাক্তার সাহেব আপনি অপারেশন শুরু করুন।আমি মাটি কেটে, ইট ভেঙ্গে দশ লাখ টাকা নিয়ে আসতেছি।
অথচ ইট ভাঙা বা মাটি কাটা শ্রমিকের রোজ তখন বড়জোর ৩০০ টাকা দৈনিক।পরিচালক আমাদের ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য থাকেন না বলে আমরা জানতে পারিনা দুই মিনিট পরেই নায়ক দশ লাখ টাকা মাটি কেটে বা ইট ভেঙে কিভাবে যোগাড় করে ফেললেন।
হাতের পালস দেখে প্রেগ্ন্যাসি নির্ণয় দেখে অভ্যস্ত সেদেশের মানুষ, সেদেশের মানুষ ডাক্তারদের কবিরাজ ভাববে এটাই স্বাভাবিক।এক ভদ্রলোক প্রশ্ন করেছেন আমাকে আগের দিনে চোখ দেখে ডাক্তার জন্ডিস বুঝে ফেলতো এখন এত টেস্ট  দেওয়া লাগে কেন? জন্ডিস তো আমরাও চোখ দেখেই বতেসকিন্ত কবিরাজদের মত জন্ডিসের কারণ কি তা জেনে শুধু বড় বড় ফাইল রোগীদের গিলাতে পারিনা দেখেই আমাদের এত বদনাম।
হেপাটাইটিস ভাইরাসের জন্য জন্ডিস হয়।সেই ভাইরাসের আবার টাইপ ৫ প্রকার।এখন আপনাকে হেপাটাইটিস এ এর জন্ডিসে হেপাটাইটিস বি এর এন্টি ভাইরাল ড্রাগস দিলে খাবেন আপনি?হেপাটাইটিস বি ও সি আপনার লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সার করতে পারে।এখন যদি আপনার জন্ডিসের কারণ যদি হেপাটোসেলুলার ক্যান্সার, তবে টেস্ট ছাড়া কিভাবে চোখ দেখে বুঝা যাবে এই জন্ডিসের কারণ??
আপনি আমার কাছে কাশি নিয়ে আসলেন।আমি আপনাকে কফ সিরাপ দিয়ে বিদায় করলাম।আপনি খুশি হয়ে গেলেন এবং কয়েকদিন পর আপনি মারা গেলেন, এটা মেনে নিবেন?কাশি তো কোন রোগ নয়, রোগের সিম্পটম।কাশি হতে পারে অনেক কারণে।যেমন ফুসফুসের টিবি, ফুসফুস ক্যান্সার, এ্যাজমা, ধূমপান জনিত শ্বাসকষ্ট সিওপিডি, ILD, ভাইরাল নিউমোনিয়া, Community acquired pneumonia,একিউট ব্রঙ্কাইটিস, ব্রঙ্কিয়্যাক্টাসিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ফ্লু,কোভিড নিউমোনিয়া, কাফ ভ্যারিয়েন্ট এজমা,এক ধরনের হাই প্রেশারের মেডিসিনের সাইড ইফেক্ট, ফরেণ বডি সহ নানা কারণে আপনি কাশি নিয়ে আসবেন ডাক্তারের চেম্বারে।
এখন আপনার কাশির ধরণ দেখে,শারীরিক পরীক্ষা ও আপনার প্রদত্ত হিস্ট্রি থেকে ডাক্তার কয়েকটা কারণ সন্দেহ করবেন।তারপর সেটা যথাযথ ইনভেস্টিগেশনের মাধ্যমে কাশির যথাযথ কারণ নিশ্চিত হয়ে আপনাকে চিকিৎসা দিবেন।এখন ক্যান্সারের জন্য যেই কাশি তাতে টিবির মেডিসিন দিলে আপনি মানবেন?তখন আবার ভুল চিকিৎসার অভিযোগ করবেন না তো?
আপনারা যারা দেশীয় চিকিৎসকদের মন্ডুপাত করে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান,সেখানের ডাক্তাররা নিশ্চয় আপনাদের টেস্ট ছাড়াই চোখের পলকে রোগ ধরে চিকিৎসা দিয়ে দেন তাইনা?সেজন্যই বিদেশি চিকিৎসকরা ফেরেশতা, দেশীয় চিকিৎসকরা কসাই।আচ্ছা দেশে যেমন ভুল চিকিৎসার অজুহাত তুলে ডাক্তারদের পিটান,চড় থাপ্পড় কিল ঘুষি দিতে উদ্ধ্যত হন,বিদেশে যখন আপনাদের স্বজন মারা যায় তখন কি এমন মাইর দেওয়ার খায়েশ জাগে??সেই ভারতের চিকিৎসা নিয়ে এত বড়াই আপনাদের সেই ভারতের কি নাকানিচুবানি হাল এই কোভিডে।লাশ ভাসছে নদীতে।শ্মশানে জায়গা নেই দাহ করার।
এত ভালো চিকিৎসক, এত উন্নত চিকিৎসার পরেও ভারতে এত মানুষ মারা যাচ্ছে কেন?এই দেশের মানুষের কাছে ডাক্তারের ভিজিট অনেক বড় লাগে।
একজন এমবিবিএস চিকিৎসক ২০০/৩০০ টাকা ভিজিট নেন তাদের ব্যক্তিগত চেম্বারে।কারো ব্যক্তিগত চেম্বার দাতব্য চিকিৎসালয় নয়।আপনি যদি গরিব, তবে আপনি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাবেন।আপনার নাগরিক অধিকার ফ্রি চিকিৎসা পাওয়া।কিন্ত কারো ব্যক্তিগত চেম্বারে আপনি ছাড় না পেলে তাকে কসাই বলে গালি দেওয়া, চামার বলা কতটুকুন সমীচীন।
আপনি যখন অন্যের থেকে দয়া, মায়া আশা করছেন,তখন আপনি নিজে সমাজের অন্য মানুষের জন্য দয়ার কি নমুনা হাজির করেছেন?সবার টাকার দরকার।বৈধ অবৈধ উপায়ে দেদারসে টাকা কামাচ্ছেন অনেকেই।শুধু ডাক্তার এর টাকা লাগে এটা মানতে চায়না এই দেশের মানবিক মানুষরা।
ডাক্তারদের বাসা ভাড়া, কারেন্ট বিল,গ্যাস বিল,বুয়া বিল,খাবার দাবার,সংসারের নানা খরচ,বাচ্চাদের খরচ,স্কুল কলেজ ফি,শিক্ষকদের বেতন, চিকিৎসা কোন কিছুতেই টাকা লাগেনা।
সব এই দেশের মানুষরা ফ্রিতে দিয়ে দেয়।বাজারে গেলে ব্যবসায়ীরা ডাক্তার শুনলে ব্যাগ ভরে সদায়পাতি দিয়ে দেন, শিক্ষকরা ডাক্তারদের বাচ্চাদের ফ্রিতে বাসায় এসে টিউশন দিয়ে যান।বিভিন্ন হাসপাতালে ডাক্তার শুনলেই পুরো চিকিৎসা ফ্রি।বাসে ট্রেনে লঞ্চে বিমানে ডাক্তারদের ভাড়া দিতে হয় না।তারপরও শালারা কসাইগিরি ছাড়ে না।টাকা ছাড়া কিছু বুঝে না।
তাই নয় কি??
আপনি হাতুড়ে ডাক্তার থেকে হাজার টাকার এন্টিবায়োটিক খেতে পারেন,১২শত টাকার ভিটামিন স্যালাইন মারাতে পারেন,সারা বছর ফাও ফাও ক্যালসিয়াম ও গ্যাসের বড়ি খেতে পারেন,আপনার বিড়ি সিগারেট,তামাক,পান,সীসা খেতে টাকার অভাব হয়না, বান্ধবীকে নিয়ে লিটনের ফ্ল্যাটে যেতে টাকার অভাব হয় না, যত অভাব ও ক্রাইসিস ডাক্তারের ব্যক্তিগত চেম্বারে ভিজিট দিতে।এই দেশে শুধু ডাক্তারদেরই ঠেকা মানবিক হবার।আর কারো মানবিক হবার দরকার নেই।
আপনি নিজে একজন পিশাচ, হিংস্র জানোয়ার, লুটপাট কারী,ঠকবাজ,ওজনে কম দেন, মজুতদারী করে দাম বাড়ান,২৫০ টাকায় পেঁয়াজ খেতে বাধ্য করেন মানুষকে, আপনি ডেঙ্গু সীজনে কয়েলের দাম বাড়িয়ে দেন, ওডোমাস ক্রিমের দাম বাড়ান দশগুন,মাস্কের ব্যবসা করেন রমরমা, সারাক্ষণই ব্যবসার ধান্ধা আপনার আপনি যখন ডাক্তারদের মানবিক হতে বলেন তখন লজ্জা লাগেনা?এতটাই বেশরম আপনি হলেন কিভাবে?
আমি গত সেপ্টেম্বরে ঢাকা থেকে কুমিল্লা আসছিলাম।গ্রামে আসবো দেখে কুমিল্লায় না গিয়ে চান্দিনায় নেমে পড়ি।তারপর সিএনজি পেলাম না।
অটোতে অর্ধেক রাস্তা আসলাম।তারপর অটো আর আসবে না।কি করি এত রাতে,তখন রাত একটা বাজে।একটা রিক্সা আমার গ্রামে আসতে রাজি হলো।
আমি ভাড়ার কথা জিজ্ঞেস করিনি।ভাবছি এইটুকুন পথ দিনে দেড়শ থেকে দুইশো টাকার ভাড়া,রাত যেহেতু ৫০০ টাকা দিয়ে দিবো।আমার বাড়ি আসার পর সেই রিক্সাওয়ালাকে আমি ১৫০০ টাকা দিতে বাধ্য হয়েছি।তারপরও রিক্সাওয়ালা খুশি নন,তিনি দুই হাজার টাকা দাবি করছেন।
একজন রিক্সাওয়ালা একজন ডাক্তারকে এইদেশে রাতে তার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে দশগুন বেশি ভাড়া পেয়েও সন্তুষ্ট হয় না।এমন দেশে ডাক্তার ছাড়া সবার মানবিকতার পাইকারি দোকান দেদারসে মানবতা বিলিয়ে যাচ্ছে।
আমি কখনো বিরাগভাজন হয়ে কারো ক্ষতি করি না।আমার পেশাগত জীবনে আমি সবসময় আমার রোগীদের প্রতি ক্নমিটেড ছিলাম।চুপচাপ রোগী দেখে গেলে আর হাতুড়ে ডাক্তারদের ভুয়া চিকিৎসা নিয়ে মানুষকে সচেতন না করলে আমার চেয়ে ধনী ডাক্তার আমার ব্যাচে কেউ থাকতো না।
কিন্ত আফসোস শুধু মানুষের জীবনের গুরুত্ব বুঝে তাদের সচেতন করতে গিয়ে অনেকবেশি দাম দিয়ে নিঃস্ব হয়েছি আমি।তারপরও মানুষকে ভালবাসি আজও।মানুষের কাছে চিকিৎসকদের প্রতিদান চাওয়ার কিছু নেই।যিনি মানুষদের বানিয়েছেন,তিনিই প্রত্যেককে তার অন্তর দেখে দেখে একদিন উপযুক্ত পুরস্কার অবশ্যই দিবেন।
আরও পড়ুন