Ads

ইসলামী সংস্কৃতির কাণ্ডারি কবি মতিউর রহমান মল্লিক

সুমাইয়া সুলতানা তামিমা

“যার জন্য দেখছি আজ
ইসলামী সংস্কৃতির জয় দিগ্বিদিক,
তিনি তো বাংলাদেশের তাজ
প্রিয় কবি মতিউর রহমান মল্লিক।”

সাধারণত কবিরা দ্বৈত চরিত্রের অধিকারী হয়ে থাকেন।তারা লেখনী এবং বক্তৃতায় যেমন চরিত্রে তার উল্টোটা ঘটতে দেখা যায়।
কিন্তু মতিউর রহমান মল্লিক এক্ষেত্রে পুরোপুরি ব্যতিক্রম ছিলেন। তিনি যা বিশ্বাস করতেন তাই বলতেন, তাই লিখতেন। বাস্তব জীবনেও তিনি তারই প্রতিফলন ঘটাতেন। আপাদমস্তক তিনি ছিলেন বিশ্বাসী ঘরানার সত্যসন্ধানী ও মানবতাবাদী কবি। বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফ এর মন্তব্যটি এ বিষয়ে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ‘মতিউর রহমান মল্লিক একজন নিবেদিত প্রাণ মানবতাবাদী কবি ছিলেন। তাঁর ইন্তিকালে বিরাট একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি শুধু কবি-সাহিত্যিক শিল্পী-সংগঠক হিসেবে বড় মাপের ছিলেন না; ব্যক্তি হিসেবেও ছিলেন অত্যন্ত উঁচুস্তরের, মতিউর রহমান মল্লিক সত্যিকার অর্থেই ছিলেন অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব।
মতিউর রহমান মল্লিক ১৯৫০ সালের ১লা মার্চ বাগেরহাট জেলার সদর উপজেলার বারুইপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মুন্সি কায়েম উদ্দিন মল্লিক স্থানীয় জারীগানের দলের জন্য গান লিখতেন। মাতা আয়েশা বেগম। তৎকালীন রেডিওতে কবি ফররুখ আহমদ যে সাহিত্য আসর পরিচালনা করতেন সেই আসরে মল্লিকের বড় ভাই কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন। পিতা মাতার সান্নিধ্যে থেকে তিনি গানের প্রাথমিক জীবন শুরু করেন। প্রাথমিক জীবনে রেডিওতে গান শুনে শুনে গান লেখা শুরু করেন। তখনকার তার প্রায় সকল গানই ছিল প্রেমের গান। পরবর্তীতে ইসলামী আদর্শে প্রভাবিত হয়ে ইসলামী ধারায় গান লেখা শুরু করেন।
মল্লিক বারুইপাড়া সিদ্দীকিয়া সিনিয়র মাদ্রাসায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর বাগেরহাট পিসি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।
‘অনিষ্টি ইজ দ্য বেষ্ট পলিসি’। কথাটি বইয়ের পাতায় ঘুরপাক খেলেও কবি মতিউর রহমান মল্লিকের জীবনে তা ছিল বাস্তবসম্মত। ব্যক্তিত্ববান মানুষ হিসেবে গড়ে উঠার পিছনে মল্লিকের সততা ছিল দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল। জীবনে কোন ধরনের লোভ লালসার ফ্রেমে তিনি আটকা পড়েননি। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে তিনি সততার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। কবি মতিউর রহমান মল্লিক ছিলেন লোভ-লালসার উর্ধ্বে সত্যিকার এক নির্ভেজাল মানুষ। দুনিয়ার প্রতি তাঁর আকাঙ্খা ততটুকু ছিল যতটুকু নিয়ে আল্লাহর দীনের পথে চলা যায়। আল্লাহর দীনের জন্য তিনি ছিলেন উৎসর্গিত প্রাণ।
কবি মতিউর রহমান মল্লিকের একটি বড় পোশাক ছিল বিনয়। অত্যন্ত বিনয়ী এ কবি সব সময় নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করতেন। যে কোন অনুষ্ঠানে কিংবা যে কোন গুণিজন অথবা সভা সমাবেশে তিনি নিজেকে খুব কম জানা-শোনা লোক হিসেবে উপস্থাপন করতেন। বৃক্ষ যত বেশি বড় হয়, যত বেশি ফলবান হয় তার মাথা ততবেশি মাটির দিকে নূয়ে পড়ে, বিনয়ী হয়; কবি মতিউর রহমান মল্লিক ছিলেন বিনয়ী ফলবান বৃক্ষ।
সংস্কৃতিকেন্দ্রের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁকে মঞ্চে বসানো অনেকটা কষ্টকর ছিল। তিনি একজন সাধারণ সংস্কৃতি কর্মীর মতো অন্যান্যদের খেদমত করতে পছন্দ করতেন। তিনি যখন কাউকে অন্যের সামনে পরিচিত করে দিতেন তখন তার বিভিন্ন গুণকে উদ্ভাসিত করে অনেক বড় গুণি হিসেবে উপস্থাপন করতেন। হৃদয়ের গভীরতা, জ্ঞানের প্রশস্ততা এবং বিনয়ের পরাকাষ্ঠা ছাড়া এমনটি সম্ভবই নয়। এক্ষেত্রে সমকালীন বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি আল মাহমুদ বলেন, ‘জ্ঞান হলো আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের বিষয়। তিনি যাকে তা দান করেন তার চেহারাটাই একটু অন্যরকম থাকে। সম্ভবত সেই চেহারা কবি মতিউর রহমান মল্লি¬কের মতোই নিষ্পৃহ, অহঙ্কারহীন ও বিনয়ী হবে হয়তো।’ সত্যিই তিনি ছিলেন বিনয়ী মানুষের একনিষ্ট প্রতিকৃতি।
কবি মতিউর রহমান মল্লিকের ছিল একটি দরদী মন। প্রতিটি হৃদয়কোষে দরদ আর ভালোবাসা বিচরণ করতো সব সময়। খাঁটি এ হৃদয়ে মানুষের কল্যাণ-ভাবনা ঘুরপাক খেতো নিয়মিত। অন্যরা মেধা ও যোগ্যতায় এগিয়ে আসুক-এটা তিনি সব সময় কামনা করতেন। কারো কোন মেধার সাক্ষর পেলে তিনি তা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে অনেক বড় করে উপস্থাপন করতেন। বিশেষত মফস্বল অঞ্চলের কোন কবি, সাহিত্যিক, সংস্কৃতি কর্মী তাঁর কাছে গেলে তিনি তার লেখা দেখে, গান শুনে অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতেন। তাকে পুরস্কৃত করার মাধ্যমে উৎসাহিত করতেন তিনি। কারো কোন বই প্রকাশ পেলে তিনি নতুন বই হাতে নিয়েই হৃদয়ের সমস্ত উচ্ছ্বাস উজাড় করে দিয়ে তাঁকে মিষ্টি খাওয়াতেন, বইয়ের টাকা বাবদ পকেটে হাত দিয়ে যতটুকু সম্ভব বেশি দিয়ে দিতেন। পকেটে টাকা না থাকলেও অন্যের কাছ থেকে ধার নিয়ে হলেও লোককে উৎসাহিত করতেন। সুযোগ হলে দ্রুত ব্যানার বানিয়ে সেই বইয়ের প্রকাশনা উৎসব করে পত্রিকায় খবর ছাপিয়ে দিতেন। অন্যকে বড় করে উপস্থাপনের মধ্যেই তিনি অফুরন্ত সুখ ও আনন্দ অনুভব করতেন। কবি আসাদ বিন হাফিজের ভাষায়-

বুকভরা মায়া তার চোখে আলো ঝিকমিক
সকলের প্রিয় ভাই, প্রিয় কবি মল্লিক।

‘ভোগে নয় ত্যাগেই প্রকৃত সুখ’ কথাটি কবি মতিউর রহমান মল্লিকের চরিত্রের সাথে পুরোপুরিভাবে মানিয়ে যায়। নিজের সংসারে অভাব থাকলেও অন্যের অভাব পূরণে তিনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তেন। যে কোন কবি-সাহিত্যিক কিংবা সংস্কৃতিকর্মী কিংবা সংস্কৃতি কর্মীর উদ্ধৃতি দিয়ে যে কোন লোক তাঁর অফিসে গেলে তিনি তাকে আতিথেয়তা দিতেন পুরোপুরি। তার কোন অভাব থাকলে তিনি প্রয়োজনে পকেট থেকে টাকা দিয়ে তাকে সাহায্য করতেন। সংস্কৃতিকর্মী ছাড়াও কারো চিকিৎসা সেবা, কারো চাকরির ইন্টারভিউ, কারো ভর্তি পরীক্ষা এরকম হাজারো কাজে অনেকে অফিসে এসে থেকেছেন। মল্লিক তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। এছাড়াও গরীব ছাত্রদের ফরম ফিলাপ, বই কেনা প্রভৃতি কাজেও প্রচুর সহযোগিতা করতেন তিনি। নিজের খাবারের টাকা না থাকলেও অন্যের খাবারের ব্যবস্থা করতে তিনি প্রয়োজনে ঋণ করতেন। তিনি না খেয়ে কষ্ট করে দিন পার করে দিতে পারতেন। নিজের অভাবের কথা কখনো কাউকে বলতেন না। আর নিজের অভাব অনটনে কখনো তিনি খেই হারাতেন না। আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে নির্দিধায় সামনে চলতেন তিনি। কবি নয়ন আহমেদ এর কবিতায়-
মল্লিকের দিকে তাকালে একটা সম্পূর্ণ ভোর দেখতাম।
সূর্যসমেত লাল উদ্দীপনা
আঁধার কেটে গিয়ে একটা স্পষ্টতা তৈরি হয়েছে,
কণ্ঠ চিরে বেরিয়ে যাচ্ছে ভালোবাসার মূর্ছনা।

কবি মতিউর রহমান মল্লিক ছিলেন মুক্ত মনের মানুষ। তাঁর মনে কোন কুটিলতা কখনো বাসা বাঁধতে পারেনি। তবে তিনি ভেতরে ভেতরে ছিলেন ভীষণ অভিমানী। সে অভিমান তাঁকে কখনো কখনো একরোখা বানিয়ে ফেলতো। শিশু মনের অধিকারী মানুষেরা সহজেই জেদী হয়ে ওঠেন এবং সহজে খুব কষ্ট অনুভব করেন, কবি মল্লিকের ভেতর এ স্বভাবটিও ছিল। তবে তাঁর মনের জমিনটা ছিল খুবই সবুজ। মুক্ত বিহঙ্গের মতো প্রাণবন্ত থাকতে পছন্দ করতেন তিনি। সবুজাভ মধুর পরিবেশ পেয়ে তিনি পাখির মতো ডানা মেলতেন। প্রাণ খুলে হাসতেন, রসিকতা করতেন। গ্রামীণ পরিবেশ, নদীর কিনার কিংবা ঐতিহাসিক কোন স্থানে গেলে তিনি নিজের আবেগকে ধরে রাখতে পারতেন না। পাখির মতো পাখনা মেলে উড়ে বেড়াতে চাইতেন। আবৃত্তি করতেন মজার মজার কবিতা, কণ্ঠে ধরতেন সুমধুর গান।

হালকা পাতলা গড়নের সহজ সরল অনাড়ম্বর এক শাদামাটা মানুষ ছিলেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক। অবিচল বিশ্বাস, পরিচ্ছন্ন মনন ও গভীর মনীষার অধিকারী সক্রিয় চেতনার এ মানুষটির কন্ঠে ছিল মধু। কি বক্তৃতা, কি আবৃত্তি, কি তিলাওয়াত; অসাধারণ এক আকর্ষণ ছিল তাঁর কণ্ঠে। যে কোন সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, সাহিত্যাড্ডা, আলোচনা অনুষ্ঠান এমনকি টেবিলের আলোচনায় তাঁর কন্ঠে যেন মুক্তো ঝরতো। অবিরাম বর্ষণের মতো শাওনের বারিধারা ছুটে চলতো তাঁর কণ্ঠ থেকে। বক্তৃতার ফাঁকে ফাঁকে প্রয়োজন মতো কুরআন, হাদীস ও কবিতার উদ্ধৃতি টানতেন। ইতিহাসের গলিপথ ঘুরে ফিরে তিনি তুলে আনতেন বক্তৃতার যাদু। ইতিহাসের উদ্ধৃতি টেনে টেনে তিনি শ্রোতাম-লীকে মুগ্ধ করে দিতেন। সাধারণত এক ঘন্টার কমে তাঁর বক্তৃতা শুনে তৃপ্তি মিটতো না। কখন যে সময় কেটে যেতো শ্রোতারা অনুমানই করতে পারতো না। তাঁর বক্তৃতার গুণমুদ্ধ শ্রোতা কবিবন্ধু হাসান আলীম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘মতিউর রহমান মল্লিকের বক্তৃতা কখনো কখনো গভীর গবেষণা দীপ্ত প্রবন্ধের মতো হয়ে যেত। সাহিত্যের বক্তৃতা ছাড়াও ধর্ম-দর্শন নিয়েও অসাধারণ বক্তৃতা এমনকি ওয়াজ নছিহত পর্যন্ত করতে পারতেন। এক্ষেত্রে তিনি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে অনুসরণ করতেন।’ দারসে কুরআন পরিচালনাতেও তাঁর অসাধারণ দক্ষতা ছিল। যেমন ছিল সুমধুর কন্ঠের তিলাওয়াত তেমনি আধুনিক বিজ্ঞান সম্মত রসালো তাফসীর শ্রোতামন্ডলীকে মুগ্ধতায় বেঁধে রাখতো।

কর্মজীবনে কবি মতিউর রহমান মল্লিক সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক, ‘বিপরীত উচ্চারণ’ সাহিত্য সংকলনও সম্পাদনা করেছেন, মাসিক কলম পত্রিকার সম্পাদক এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ সংস্কৃতি কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ছিলেন।
প্রচার বিমুখ এ ব্যক্তিটি কাজ করেছেন মানুষের জন্য,মানবতার জন্য, বিশ্বাসের জন্য। ছোট বড় সবার জন্য লিখেছেন তিনি। তার লেখা অনেক কিন্তু কমই প্রকাশিত হয়েছে। ব্যক্তিগত সফলতার চেয়ে আদর্শিক সফলতার কথাই বেশি ভেবেছেন। তার ভক্ত শুভাকাঙ্খীদের আকুল আকতিতে কথা ও সুর নিয়ে সংস্কৃতিপ্রেমীদের মাঝে উৎসাহের কারণে কিছু কাজকে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করেছেন।-
নীষন্ন পাখির নীড়ে (কাব্যগ্রন্থ):আত্ম প্রকাশন
সুর-শিহরণ (ইসলামি গানের বই)
যত গান গেয়েছি (ইসলামি গানের সঙ্কলন)
ঝংকার (গানের বই)
আবর্তিত তৃণলতা (কাব্যগ্রন্থ) মোনালিসা প্রকাশন
তোমার ভাষার তীক্ষ্ন ছোরা (কাব্যগ্রন্থ) বাংলা সাহিত্য পরিষদ
অনবরত বৃক্ষের গান (কাব্যগ্রন্থ) মোনালিসা প্রকাশন
চিত্রল প্রজাপতি (কাব্যগ্রন্থ) প্রফেসর’স পাবলিকেশন্স
নির্বাচিত প্রবন্ধ (প্রবন্ধের বই)
রঙিন মেঘের পালকি (ছোটদের ছড়ার বই) জ্ঞান বিতরণী
প্রতীতি এক (ইসলামি গানের ক্যাসেট)
প্রতীতি দুই (ইসলামি গানের ক্যাসেট)
প্রাণের ভিতরে প্রাণ (গীতিকাব্য) উল্লেখযোগ্য।
অনুবাদক হিসেবে তার রয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। পাহাড়ি এক লড়াকু নামে আফগান মুজাহিদদের অমর কীর্তিকলাপ তার বিখ্যাত অনুবাদ উপন্যাস যা কিশোর কণ্ঠের পাঠকরা মন উজার করে পড়তেন নিয়মিত। মহানায়ক (উপন্যাস) ছাড়াও হযরত আলী ও আল্লামা ইকবালের মতো বিশ্বখ্যাত মুসলিম কবিদের কবিতাও অনুবাদ করেছেন তিনি।

সুন্দরের সকল আয়োজনই শিল্প; আর সুন্দরের নির্মাতাগণই শিল্পী। এ কাজে যিনি যত মহৎ শিল্পকর্ম উপস্থাপন করতে পারেন তিনি তত বড় শিল্পী। বিশ্বাসী মানুষেরা তাই মহান স্রষ্টা হিসেবে আল্লাহকে এবং অবিশ্বাসীরা প্রকৃতিকে সবচেয়ে বড় শিল্পী হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন। মানুষ কোন কিছু সৃষ্টি করতে না পারলেও স্রষ্টার মূলসূত্রকে অবলম্বন করে নতুন নতুন বিষয়কে নিজস্ব ঢঙে আবিষ্কার করেন। এজন্য মানুষের নির্মাণকেও এক ধরনের সৃষ্টি বলে আখ্যা দেয়া হয়। সাধারণভাবে সকল সৃষ্টিকর্মই শিল্পের আওতায় আনা হয়ে থাকে। তবে তাতে মননশীলতা ও নান্দনিকতার ছাপ যত বেশি থাকে তাকে তত সফল শিল্পকর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এটা হতে পারে কোন বস্তুগত শিল্পকর্ম কিংবা মানবীয় ও জৈবিক শিল্পকর্ম। একজন শিল্পীর সৃষ্টিকর্ম এবং মানবিক সত্তার মধ্যে যদি সমন্বয় ঘটে তবে তিনি হয়ে ওঠেন অমর শিল্পী। আর সে কারণেই মতিউর রহমান মল্লিককে একজন অমর শিল্পী হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। লেখনী, কণ্ঠ এবং সমাজ বাস্তবতায় তিনি ছিলেন একাকার। তাঁর কলমে যেমন আবিস্কৃত হয়েছে- ‘যে কোন কাজ করো রে ভাই যে কোন কাজ করো/ তা যেন হয় সবার চেয়ে সবচেয়ে সুন্দরো’ তেমনি বাস্তব জীবনেও তিনি সুন্দরকে বেছে নিতে আমৃত্যু সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর প্রতিটি কাজই ছিল শিল্পসম্মত। খাওয়া, গোসল, গোসল শেষে কাপড়টা শুকানোর জন্যে মেলে দেয়া, অফিসের টেবিলে খাতা-পত্র রাখা, চুল-দাড়ি আঁচড়ানো, এমনকি তাঁর হাসিও ছিল শিল্পসম্মত।

কবি মতিউর রহমান মল্লিক ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত আড়ালপ্রবণ মানুষ ছিলেন। নিজেকে লুকিয়ে রাখার মধ্যেই যেন সুখ খুঁজে পেতেন তিনি। তবুও সারাদেশের মানুষ তাঁকে সামনে টেনে এনেছেন. হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসা উজার করে তাঁকে সম্মাণিত করার চেষ্টা করেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় তিনি লক্ষ্য করলেন মানুষ অশ্লীল সংস্কৃতিতে অনেক বেশি আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে, তাই তিনি মুসলিম হিসেবে ইসলামকে প্রচার করতে প্রতিষ্ঠা করলেন নানান কলাকৌশল। অশ্লীল গানের বিপরীতে ইসলামী গান, অশ্লীল নাটকের বিপরীতে ইসলামী নাটক সহ কবিতা, গল্প ইত্যাদি। গড়ে তুললেন সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী নামক এক কালজয়ী সাংস্কৃতিক সংগঠন। এখনকার কলরবসহ যত ধরনের শিল্পগোষ্ঠী আছে তা সব এই সাইমুমেরই একেকটা অংশ।
সাহিত্য সংস্কৃতির টানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছুটে বেড়িয়েছেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক। বিশেষত, ইউরোপের ইয়ং মুসলিম অর্গানাইজেশন এর আহ্বানে ১৯৮৫ সালে বৃটেন, স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অব ইন্ডিয়ার বার্ষিক সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে ১৯৯২ সালে ভারত, ২০০০ ও ২০০১ সালে ইকবাল পরিষদ আয়োজিত সেমিনারে ভারত, ২০০২ সালে ফ্রান্সের বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিষদের আমন্ত্রণে ফ্রান্স এবং সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অতিথি হিসেবে ২০০২ সালে সিঙ্গাপুর এবং ২০০৩ সালে সৌদি আরব সফর করেন।মতিউর রহমান মল্লিক বাংলাদেশের ইসলামী গানের একজন বিখ্যাত কন্ঠশীল্পী। মতিউর রহমান মল্লিক শৈশব থেকেই বিভিন্ন ধরনের সংগঠন গড়ে তুলতে থাকেন। ১৯৭৮ সালে ঢাকায় সমমনা সাংস্কৃতিক কর্মীদের নিয়ে গড়ে তোলেন ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী। তারপর একে একে তার অনুপ্রেরণায় বাংলাদেশের শহর, নগর, গ্রাম, গঞ্জ, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যায়ল ও মাদরাসায় গড়ে ওঠে একই ধারার অসংখ্য সাংস্কৃতিক সংগঠন। শুধু তাই নয়, পশ্চিমবঙ্গ, আসামসহ বিশ্বের যেখানেই বাংলাভাষাভাষী মুসলমান রয়েছে সেখানেই গড়ে উঠেছে একই ধারার বহু সাংস্কৃতিক সংগঠন।

কবি মতিউর রহমান মল্লিকের কলমে এক অসাধারণ বৈচিত্রতেজ লক্ষণীয়। তাঁর কবিতায় গীতলতার স্বাভাবিক আবহ চোখে পড়লেও গান ও কবিতার ভাঁজে ভাঁজে পার্থক্যের দেয়াল খুব শক্ত। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ আবর্তিত তৃণলতা, অনবরত বৃক্ষের গান, তোমার ভাষায় তীক্ষè ছোরা, চিত্রল প্রজাপতি, নিষণœ পাখির নীড়ে কিংবা ছড়াকাব্য রঙিন মেঘের পালকির সাথে গানের সংকলন ঝংকার ও যতগান গেয়েছি’র মধ্যে পার্থক্যের প্রাচীর খুব মজবুত। কাব্যের শব্দগাঁথুনিতে গীতলতার দোলা থাকলেও তা গানের শব্দভঙ্গি থেকে পুরোপুরি ভিন্ন স্বাদের। এখানেই কবি মল্লিক এবং গীতিকার মল্লিকের এক অসাধারণ বৈচিত্রঘ্রাণ ভেসে আসে। মল্লিকের গানের ভাষা থেকে তার কাব্যভাষা সম্পূর্ণ আলাদা, স্মার্ট, সুন্দর ললিত এবং অনেক ক্ষেত্রে তৎসম তদ্ভব শব্দগুচ্ছে আবৃত। লালিত্যে, চিত্র-কল্পে, অলঙ্কারে মল্লিকের কবিতা মল্লিকাময়।

কণ্ঠশিল্পী হিসেবেও অসাধারণ কৃতিত্বের অধিকারী কবি মতিউর রহমান মল্লিক। প্রতীতি-১ এবং প্রতীতি-২ তাঁর স্বকণ্ঠে গাওয়া অডিও এ্যালবাম। বিশ্বাসী চেতনাকে শাণিত করার প্রয়াসে নির্মিত এ এ্যালবাম দীর্ঘ দুই দশক একচ্ছত্র ভূমিকা পালন করেছে বলা যায়। গানের ভাষা, সুর-কন্ঠ এবং প্রতীকের মোহনীয় ব্যবহার তৃষিত হৃদয়কে তৃপ্ত করে তোলে। এছাড়াও যে সব এ্যালবামে তিনি কণ্ঠ দিয়েছেন সেখানেও তাঁর কন্ঠের স্বাতন্ত্রতা অতি সহজেই অনুধাবন করা যায়। সত্যিকার অর্থে সফল গীতিকার-সুরকার ও শিল্পী হিসেবে সঙ্গীত জগতেও তিনি একজন অমর ব্যক্তিত্ব।
মতিউর রহমান মল্লিক হলেন একজন বাংলাদেশী কবি, সাহিত্যিক, সংগীত শিল্পী, সুরকার ও গীতিকার। তিনি বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। যিনি ইসলামী ধারায় অসংখ্য গান ও কবিতা রচনা করেছেন। তাকে অনেকেই সবুজ জমিনের কবি ও মানবতার কবি বলে থাকেন।
✓তার লেখা কিছু জনপ্রিয় গান:-
•তোমার সৃষ্টি যদি হয় এত সুন্দর
•টিক টিক টিক টিক যে ঘড়িটা
•রাসুল আমার ভালবাসা
পৃথিবী আমার আসল ঠিকানা নয়
•এলো কে কাবার ধারে
•সে কোন বন্ধু বলো
•আম্মা বলেন ঘর ছেড়ে তুই
•এ আকাশ মেঘে ঢাকা রবে না
•কথায় কাজে মিল দাও আমার
•এসো গাই আল্লাহ নামের গান
•হঠাৎ করে জীবন দেওয়া খুব সহজ
•আয় কে যাবি সঙ্গে আমার
•গান শোনাতে পারি
•আন্দোলন সে জীবনের অন্য নাম
•যদি কেউ বুঝে থাকো
•এত শহিদ রক্ত ঢালে
•ধৈর্য্য ধারণ করার শক্তি দাও
•যা কিছু করতে চাও
•এখানে কি কেউ নেই
•ঘন দুর্যোগ পথে দুর্ভোগ
•এই দূর্যোগে এই দূর্ভোগে আজ
•চলো চলো চলো মুজাহিদ
•একজন মুজাহিদ কখনও বসে থাকে না
•সাহসের সাথে কিছু স্বপ্ন জড়াও
•সংগঠন কে ভালবাসি আমি
•কার কতটা ঈমান আছে
•জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ বীর মুজাহিদ জিন্দাবাদ
•আমার গানের ভাষা জীবনের সাথে যেন
•কোন সাহসে চাও নেভাতে অগ্নিগিরি বল
•দৃষ্টি তোমার খুলে রাখো
•রোদের ভিতর ইলশে গুড়ি
•হে খোদা মোর হৃদয় হতে
•এই দুটি চোখ দিয়েছ বলে
•না হয় হলো মন শুকনো কোন মরুভূমি
•আমাকে যখন কেউ প্রশ্ন করে
•কি হবে হতাশ হয়ে
•উত্তাপে উজ্জ্বল রক্তিম সময়ে
•জিহাদ করতে চাই আমি
•সারা বাংলার গ্রামে গঞ্জে
•এই গুনাহগার প্রভু
•মনটা কাজ দিন
•রাতের আঁধার কেটে কেটে
এছাড়া আরও অসংখ্য জনপ্রিয় গানের অমর সৃষ্টির শিল্পী তিনি।
সাহিত্যকর্মে অসাধারণ অবদানের জন্য তিনি বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। কবি মতিউর রহমানের প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য পুরস্কার ও সম্মাননাঃ
•সাহিত্য পুরস্কার : সবুজ-মিতালী সংঘ, বারুইপাড়া, বাগেরহাট
•স্বর্ণপদক : জাতীয় সাহিত্য পরিষদ, ঢাকা
•সাহিত্য পদক : কলমসেনা সাহিত্য পুরস্কার, ঢাকা
•সাহিত্য পদক : লক্ষ্মীপুর সাহিত্য সংসদ
•সাহিত্য পদক : রাঙামাটি সাহিত্য পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম
•সাহিত্য পদক : খানজাহান আলী শিল্পীগোষ্ঠী, বাগেরহাট
•সাহিত্য পদক : সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদ
•সাহিত্য পুরস্কার : সমন্বিত সাংস্কৃতিক সংসদ, বাগেরহাট
•প্যারিস সাহিত্য পুরস্কার : বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিষদ, ফ্রান্স
•বায়তুশ শরফ সাহিত্য পুরস্কার : বায়তুশ শরফ আঞ্জুমানে ইত্তেহাদ বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম
•ইসলামী সংস্কৃতি পুরস্কার : ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদ, চট্টগ্রাম
•সাহিত্য পুরস্কার : বাংলা সাহিত্য পরিষদ, ফ্রান্স।
•কিশোর কণ্ঠের সাহিত্য পুরস্কার।
মৃত্যু: মতিউর রহমান মল্লিক ১২ আগস্ট ২০১০ সালে বুধবার দিবাগত রাত ১২:৪৫ মিঃ রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে কিডনী সমস্যায় ভুগেছেন প্রিয় কবি। বাংলাদেশ তাকে আজীবন স্বরন রাখবে। আল্লাহ তাকে জান্নাতের সু উচ্চ মাকামে আসীন করুন আমীন 💙

লেখকঃ কবি ও  কলাম লেখক 

আরও পড়ুন-

চীনকে পরাস্তকারী পূর্ব তুর্কিস্তান তথা উইঘুরের অচেনা বীর উসমান বাতুর

আরও পড়ুন